বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ কোটির বেশি মানুষ। মহামারির দেড় বছরেও গতি হারায়নি সংক্রামক রোগটি। এমন পরিস্থিতিতে জোরেশোরে করোনা প্রতিরোধী গণটিকা কার্যক্রম চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন, ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন, রাশিয়ার স্পুৎনিক-ভি, চীনের সিনোভ্যাক-সিনোফার্মাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করোনা প্রতিরোধী টিকার প্রয়োগ চলছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে।
সবগুলো টিকাই দেয়া হচ্ছে কাঁধ ও বাহুর সংযোগস্থলে পুরু মাংসপেশিতে। যে কারণে ছবিতে দেখা যায়, টিকা প্রয়োগের সময় গ্রহীতাদের হাতের ওপর ইনজেকশনের সুচটি খাড়া অবস্থায় ধরে রেখেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
টিকা শিরায় প্রয়োগ করা হলে সুচটির অবস্থান থাকত অনেকটা শোয়ানো ভঙ্গিতে।
শিক্ষা ও বিজ্ঞান সাময়িকী দ্য কনজারভেশনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সব না হলেও বেশির ভাগ রোগের টিকাই দেয়া হয় মাংসপেশিতে। একে বলা হয় ‘ইন্ট্রামাসকিউলার ইনজেকশন’। এর বিপরীতে কিছু রোগের টিকা খাওয়ানো হয়, যেমন রোটাভাইরাস; আর হাম, মাম্পস ও রুবেলার মতো রোগগুলোর টিকা প্রয়োগ করা হয় ত্বকের ঠিক নিচে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ করোনা টিকার প্রযুক্তিতে ভিন্নতা থাকলেও সবগুলোর কাজ একই- আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অ্যান্টিজেনের সঙ্গে পরিচিত করে তোলা।
দেহে উপস্থিতি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিভিন্ন অংশ হলো অ্যান্টিজেন। করোনার ক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে তা নির্মূলের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধে কাজ করে টিকাগুলো।
প্রশ্ন হলো, কেন মাংসপেশিতেই দেয়া হয় এই টিকা। ত্বকের নিচের চর্বি কিংবা রক্তের শিরায় কেন দেয়া হয় না। অথবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাকের মাধ্যমে যেহেতু দেহে করোনা প্রবেশ করে, সেখানে ভাইরাসের প্রবেশ ঠেকাতে সরাসরি নাকেই কেন টিকাটি দেয়া হয় না?
যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশে ন্যাজাল টিকা অনুমোদিত। সাধারণ ফ্লু প্রতিরোধে মিস্টের মতো নাকে স্প্রে করে দেয়া হয় এই টিকা।
কিন্তু স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে করোনা প্রতিরোধে কার্যকারিতার দিক থেকে ইনজেকশনের মাধ্যমে টিকার বিকল্প এখন পর্যন্ত নেই, যা প্রয়োগ করা হয় মাংসপেশিতে।
মাংসপেশির জোর
ওয়াল্টার অ্যান্ড এলিজা হল ইনস্টিটিউটের ইমিউনোলজি গবেষক জোয়ানা গ্রুম জানান, আমাদের ত্বকের নিচে চর্বির স্তর ছাড়াও মাংসপেশিতে চমৎকার রক্তপ্রবাহের ব্যবস্থাও রয়েছে। তাই মাংসপেশিতে টিকা দিলে তা রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে দ্রুত দেহের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যেতে সক্ষম।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মাংসপেশিতে রোগ প্রতিরোধী কোষ থাকে, যা ‘ডেনড্রিটিক সেল’ নামে পরিচিত। এসব কোষ দ্রুত নিজ দেহের বহিঃআবরণে অ্যান্টিজেনকে আটকে ফেলে, অনেকটা আঠা দিয়ে পতাকা জড়িয়ে নেয়ার মতো।
এরপর এসব ডেনড্রিটিক সেল সারা দেহে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে আমাদের শ্বেত রক্তকণিকা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোকে চিনে নিতে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ শুরু করে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সীমিত
মাংসপেশিতে টিকা প্রয়োগে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেহের ওই নির্দিষ্ট অংশেই সীমাবদ্ধ থাকে। কেবল ইনজেকশন নেয়া স্থানটিতে জ্বলুনি বা ফুলে যাওয়ার মতো সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।
ত্বকের নিচে চর্বিতে টিকা প্রয়োগে প্রদাহের মাত্রা বেশি হতে পারে, কারণ চর্বিতে রক্ত চলাচল খুব কম। টিকার উপাদানও ভালোভাবে শুষে নিতে পারে না চর্বি। অপরদিকে রক্তের শিরায় টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রদাহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
কেন হাতের মাংসপেশিতেই টিকা দেয়া হয়
এ ছাড়া মাংসপেশির আকৃতি, টিকার সহজলভ্যতা আর রোগীর গ্রহণক্ষমতার ওপরেও কীভাবে টিকা দেয়া হবে, তা নির্ভর করে।
তিন বছরের বেশি বয়সী শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের টিকা দেয়া হয় বাহুর ওপরের অংশে। তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতের আকৃতি ছোট ও সুগঠিত নয় বলে তাদের টিকা দেয়া হয় উরুর পেছনের অংশে।
আবার ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধে বা মহামারির বিস্তার ঠেকাতে অল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়ার চাপ থাকে। সময়ের স্বল্পতা ও সামাজিক আচারের কারণে গণটিকা কেন্দ্রে পোশাক খুলে উরুতে টিকা নেয়া প্রায় অসম্ভব।
এদিক থেকে জামার হাতা গুটিয়ে টিকা নেয়া ও দেয়া রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মী- উভয়ের জন্যই সুবিধাজনক।
সবদিক বিবেচনায় করোনা টিকা নেয়ার জন্য প্রাপ্তবয়স্কের হাতের মাংসপেশির বিকল্প নেই।