বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যুগান্তকারী থিওরি অফ রিলেটিভিটি তত্ত্বের জন্য আলবার্ট আইনস্টাইনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণাকে বদলে দেয়া এই তত্ত্বের গাণিতিক দিকটি বুঝিয়েছেন আরেক জন, তিনি হলেন নারী গণিতবিদ এমি নুটের। নুটেরের সাহায্য পেয়েছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। জার্মান এই গণিতবিদকে নিয়ে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লিখেছেন ইউজিনিয়া চেং। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য চেংয়ের নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
নম্বর মনে রাখতে আমার খুব সমস্যা হয়; সাধারণ গণিতবিদের মতো নম্বর নিয়ে আমার কোনো আবেগ নেই। তাই কোনো ফোন নম্বর মনে রাখতে চাইলে সেটাকে আমার সঙ্গীতের নোট বা শব্দে অনুবাদ করে নিতে হয়। এটাকে আমি একটা গাণিতিক প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখি। কারণ গণিত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে আমাদের চিন্তাধারাকে সহায়তা করে। প্রায়ই আমরা কঠিন কিছু নিয়ে ভাবা শুরু করে সহজাত কোনো কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি।বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রতিভাবান জার্মান গণিতবিদ এমি নুটেরের উদাহরণটা এ ক্ষেত্রে আমার পছন্দ। ১৪ এপ্রিল তার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। তার জীবন ও গণিতের গল্প এখনও প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা গ্রহণের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি ছিলেন অগ্রদূতের ভূমিকায়। ইউনিভার্সিটি অফ গোটিনগেনের শিক্ষক হওয়ার পর ইহুদি পরিচয়ের কারণে নাৎসিরা তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার ব্রিন মার কলেজে কাজের সুযোগ পান নুটের। তবে এর দুই বছর পর ১৯৩৫ সালে ৫৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।তারপরও নুটের আধুনিক অ্যাবস্ট্রাক্ট ম্যাথমেটিকসের ভিত গড়ে দিয়েছেন। সে সময়ে গণিতবিদরা কোনো বস্তুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার বদলে বস্তুর সাধারণ বস্তুগত পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। সংখ্যা ও পাটিগণিত নিয়ে গবেষণার বদলে সাধারণ পদ্ধতিতে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি, যেখানে সাধারণ নিয়মে যোগ বা বিয়োগ করা যায় এবং দেখানো যায় যে সংখ্যা একটি উপকরণ ছাড়া আর কিছুই না।অন্যান্য উদাহরণের ক্ষেত্রেও আমরা সেই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করতে পারি। আধুনিক গণিতের ক্ষেত্রে এটা মূল ধারণা, যেটার আরম্ভ হয়েছিল নুটেরের গবেষণার মাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, নুটের দারুণ একটি উপপাদ্য প্রমাণ করার মাধ্যমে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের যোগসূত্র দেখান।গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট ও ফিলিক্স ক্লাইন আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। ১৯১৫ সালে গণিত বিশেষজ্ঞ হিসেবে নুটেরকে তারা সাহায্যের জন্য গোটিনগেনে আমন্ত্রণ জানান। আইনস্টাইনকেও তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আইনস্টাইন, হিলবার্ট ও ক্লাইনের মধ্যে চিঠিপত্র চালাচালি ও আলোচনা শুরু হয়, যেখানে বারবার উঠে আসে যে, পদার্থবিজ্ঞানের পেছনে গণিতের অংশটুকু বুঝতে নুটের তাদের কতটা সাহায্য করেছেন।আইনস্টাইনের তত্ত্বে বস্তুর অবিনাশিতাবাদের নিয়মটুকু কতটুকু খাটে, সেটা তারা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। অবিনাশিতাবাদের নিয়ম অনুযায়ী, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস সম্ভব নয়, শুধু এক রূপ থেকে আরেক রূপে শক্তির পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।কৌণিক ভরবেগের অবিনাশিতাবাদের কারণে ফিগার স্কেটাররা তাদের হাত ও পা ভেতরের দিকে টানার ফলে দ্রুত বেগে ঘুরতে পারেন। কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থানের সময় বাড়িয়ে রাখা হাত বা পায়ে কৌণিক ভরবেগ বেশি থাকে, যে কারণে হাত বা পা গুটিয়ে আনলে কৌণিক ভরবেগ ধরে রাখতে ঘূর্ণনের সংখ্যাও বেড়ে যায়।নুটের বুঝতে পেরেছিলেন যে গাণিতিক প্রতিসাম্যের সঙ্গে বস্তুর অবিনাশিতাবাদের যোগাযোগ আছে। তিনি দেখেন যে, শক্তির অবিনাশি বৈশিষ্ট্য সময়ের প্রতিসাম্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সেটি হলো, সময় যাই থাকুক না কেন, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র সবসময় একই থাকবে।কৌণিক ভরবেগের অবিনাশিতাবাদ নির্ভর করে স্পেসের ঘূর্ণনের প্রতিসাম্যের ওপর। আমরা যে মুখি হয়েই থাকি না কেন, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র পাল্টাবে না।এর অর্থ আমরা সরাসরি অবিনাশিতাবাদের দিকে চোখ না রেখে প্রতিসাম্যের দিকেই তাকাতে পারি। পদার্থবিদরা অবিনাশিতাবাদ বোঝার জন্য গাণিতিক প্রতিসাম্যের সব তত্ত্বকে যাচাই করে দেখতে পারেন, যা আপেক্ষিকতাবাদের মতো অত্যন্ত জটিল বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করতে তাদের সহায়ক হবে।যুগান্তকারী তত্ত্বটির জন্য যথার্থভাবে আইনস্টাইনকেই কৃতিত্ব দেয়া হয়, কিন্তু আমার মনে হয় নুটেরের অবদানেরও স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। আমরা সাধারণত বড় কোনো আবিষ্কার বা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা কোনো সমস্যা সমাধানকে উদযাপন করি; কিন্তু যারা যোগাযোগ, সম্পর্ক ও উপলব্ধির সেতুবন্ধন তৈরি করেন তাদের নিয়েও উদযাপন করার সময় এসেছে।