বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাজুর সোলার ফ্যানে বাতাসের সঙ্গে মেলে ছায়াও

  •    
  • ৪ আগস্ট, ২০২১ ০৯:৪৪

রাজু বলেন, ‘আমি একদিন একটা ক্ষেতের সাইডে বইসে আছিলাম। দেখলাম, মেলা রইদের জন্যে এক কৃষক ফিড (অজ্ঞান) অয়ে (হয়ে) গেলো গা। পরে সবাই ধরাধরি কইরে মাথাত পানি দিল। তারপর ওই বেডা আস্তে আস্তে বালা (ভালো) অইলো (হলো)। এরপর আমি চিন্তা করলাম, কৃষকদের জন্যে কী করন যায়। পরে ৯ মাস গবেষণা কইরে কৃষকের ছায়া আর বাতাসের জন্যে আমি সোলার ফ্যান বানাই।’

জামালপুর সদরের শরিফপুর ইউনিয়নের বেপারীপাড়ার রাজু আহম্মেদ পড়াশোনা করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর টানা ২৫ বছর ধরে করছেন ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ।

বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যান ঠিক করা এবং এর কয়েল বাঁধানো রাজুর প্রধান কাজ হলেও কৃষিযন্ত্র নিয়ে কাজ করা তার নেশা।

এটি করতে গিয়ে রাজু এমন একটি ফ্যান তৈরি করেছেন, যা জীবন বাঁচাতে পারে তীব্র রোদে মাঠে কাজ করা কৃষকদের।

এ ফ্যানে বাতাস যেমন মেলে, সঙ্গে ছায়াও পাওয়া যায় রোদ থেকে। ফ্যান চলে সোলার প্যানেলের সূর্যের আলোর শক্তিতে। এ কারণে এর নাম দিয়েছেন ‘সোলার ফ্যান’। এতে বিদ্যুৎ সংযোগ যেমন লাগে না, পাশাপাশি সোলার প্যানেলটি এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যাতে মাথায় ছায়াও পাওয়া যায়।

বহন করাও কষ্টদায়ক নয়। মাত্র আড়াই কেজির সোলার ফ্যানটি কাঁধে লাগিয়ে মাঠজুড়ে কাজ করতে পারেন কৃষক।

রাজু জানান, এ ধরনের ফ্যান তৈরির চিন্তা তার মাথায় আসে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

তিনি বলেন, ‘আমি একদিন একটা ক্ষেতের সাইডে বইসে আছিলাম। দেখলাম, মেলা রইদের জন্যে এক কৃষক ফিড (অজ্ঞান) অয়ে (হয়ে) গেলো গা। পরে সবাই ধরাধরি কইরে মাথাত পানি দিল। তারপর ওই বেডা আস্তে আস্তে বালা (ভালো) অইলো (হলো)।

‘এরপর আমি চিন্তা করলাম, কৃষকদের জন্যে কী করন যায়। পরে ৯ মাস গবেষণা কইরে কৃষকের ছায়া আর বাতাসের জন্যে আমি সোলার ফ্যান বানাই।’

রাজু কাজ করেন শরিফপুর বাজারে ছোট্ট একটি দোকানে ইলেকট্রিশিয়ানের সহযোগী হিসেবে। সেই দোকানেই তার সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।

রাজু বলেন, ‘কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষণা কইরেই আমার দিন যাইতাছে। এরপরে যা কামাই করি তার অর্ধেক সংসারে দেই আর অর্ধেক গবেষণার জন্যে মাল (যন্ত্রপাতি) কিনি। আমি পয়লা ২০১১ সালে আম পাড়ার ডিজিটাল একটা যন্ত্র বানাই।

‘এইডেই প্রথম। এরপরে ২০১৬ সালে কইডা (কয়েকটা) মেশিন বানাইছিলাম। যেডে (যেটা) দিয়ে ঘাস কাটা যায়, মাটির ঢেলা পরিষ্কার করা যায়, ক্ষেত নিড়ানো যায়, হাল দেয়া যায়, মই দেয়া যায়, ভুট্টার বীজ বপন করা যায়।

‘এরপর ২০১৭ সালে মোবাইল দিয়ে পাখি তাড়ানোর এডা (একটা) মেশিন বানাই। সরকারি লোকেরা এডার নাম দিছিলো ডিজিটাল কাকতাড়ুয়া।’

তিনি জানান, ওই যন্ত্রগুলো এখন আর তার কাছে নেই। বিভিন্ন সময় সরকারি কর্মকর্তারা এসে নিয়ে গেছেন, কিন্তু পরে আর সাড়া পাননি।

এসব কারণে ২০১৭ সালে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অভাবেও পড়েন। এরপর টানা তিন বছর এ ধরনের কাজ থেকে দূরে ছিলেন। এরপরই ক্ষেতের পাশে বসে থাকা অবস্থায় কৃষকের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ওই ঘটনাটি দেখেন।

তারপরই ফ্যানটি তৈরি করেন তিনি। যন্ত্রটি তৈরি করতে রাজু ২০ ওয়াটের একটি সোলার প্যানেল, ১২ ভোল্টের ডিসি দুটি ছোট ফ্যান, দুটি সুইচ, একটি বেল্ট ও বডি মেকানিক্যাল ব্যবহার করেছেন।

রাজু বলেন, ‘এইটা বানাইতে আমার অনেক খরচ হইছে। ব্যাটারি দিলে অনেক ওজন হয়, আর কারেন্টের বানাইলে কৃষকের খরচ বেশি হইব। তাই সোলার ফ্যান বানাইছি।

‘প্রথমে দুইটা ফ্যানের ওজন বেশি হওয়ায় বাদ দিয়ে দিছি। পরে এখন এইটা বানাইছি। এইটার ওজন আড়াই কেজি। এইডা বানাইতে আমার চৌদ্দ শ টাকা খরচ হইছে।’

সোলার ফ্যান নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যদি সরকারি সহায়তা পাই, তাহলে এই ফ্যানটি চারভাবে নির্মাণ করে বাজারে ছাড়মু। এর ফলে কৃষকরা অনেক উপকৃত হইব। যদি ভালোভাবে বানাতে পারি তাইলে কৃষকরা ৩০০ থাইকে শুরু কইরে ১ হাজার টাকার মধ্যে এই ফ্যান কিনতে পারব।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে রাজু বলেন, ‘আমি একটা ইঞ্জিন বানাইছি। যেইডে (যেটা) কোনো জ্বালানি ছাড়া শুধুমাত্র বাতাস দিয়ে চলব। এর কাজ ৯০ শতাংশ শেষ।

‘কিছু কাজ বাকি আছে। এর জন্যে অনেক টাকার প্রয়োজন, তাই সরকারি সহায়তার খুব প্রয়োজন।’

রাজুর ফ্যান ব্যবহারকারী এমদাদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে ক্ষেতে কাম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাইতাম। ঘাম হইত, অসুখ হইত, মাতা বেন্দা (ব্যথা) করত। এহন এই ফ্যান ব্যবহার করলে অনেক বাতাসও লাগে আবার ছায়াও আসে। তাই আমি মাঝে মধ্যে রাজু ভাইরে ডাক দিয়ে আইনে এই ফ্যান ব্যবহার করি।’

শরিফপুর ইউনিয়নের আরেক কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘রাজু যে ফ্যানডা বানাইছে। এইডে আমারসহ সব কৃষকেরই দরকার। কিন্তু রাজুর কাছে টাকা নাই। তাই চাহিদা থাকলেও ফ্যান সাপ্লাই দিবার পাইতাছে না।’

একই ইউনিয়নের বাসিন্দা মামুন আনসারী সুমন বলেন, ‘যাদের রৌদ্রে বের হতে সমস্যা হয়, তারা এই সোলার ফ্যানটি ব্যবহার করতে পারেন। এতে রোদ থেকে বাঁচা যাবে আর বাতাসও পাওয়া যাবে।’

শরিফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমার পরিষদের পক্ষ থেকে রাজুকে যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার করব। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।’

রাজুর সোলার ফ্যান নিয়ে জামালপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মঞ্জুরুল কাদির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাজু উদ্ভাবন পাগল একজন মানুষ। সে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে খুবই ভালোবাসে। তবে সে অত্যন্ত গরিব বলে এই যন্ত্রটি উন্নত করতে পারছে না।’

তিনি জানান, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে তারা জয়দেবপুরে কৃষি প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। রাজুকে প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহযোগিতা করা যায় কি না সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এ বিভাগের আরো খবর