কয়েক লাখ বছর আগেও সংখ্যার সাংকেতিক চিহ্নের ব্যবহার ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।
কিন্তু জীবন বদলে দেয়া এই উদ্ভাবনের উৎস কী, কোথায়, কবে; কিভাবে মানুষ গুণতে শিখেছিল; গণিত মানবজীবনে কখন, কেন আর কিভাবে প্রাত্যাহিক ও অপরিহার্য হয়ে উঠলো- সেসবের বিস্তারিত জানা গবেষকদের পরবর্তী উদ্দেশ্য।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে বর্তমান ফ্রান্সের পশ্চিমাঞ্চলে হায়েনার উরুর শক্ত একটি হাড়ের টুকরো আর একটি পাথরের খণ্ড নিয়ে কাজ শুরু করেছিল এক নিয়ানডারথাল।
যখন তার কাজ শেষ হয়, ওই হাড়ের টুকরোতে পাথর দিয়ে খোদাই করা রেখার আকারে প্রায় সমান্তরাল নয়টি খাঁজ তৈরি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, কিছু বোঝাতে চাওয়া হয়েছে সেটির মাধ্যমে।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সের আদি রূপ হলো নিয়ানডারথাল। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে নিয়ানডারথালরা বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়।
আর হায়েনার হাড়ের ওই টুকরোটি অঙ্গুলেম অঞ্চলের কাছে লে ফারদেলে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনস্থলে খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা।
সংখ্যা আবিষ্কার ও ব্যবহারের শুরুটা নিয়ে এখন পর্যন্ত গবেষণার সংখ্যা বা পরিসর খুব বেশি নয়।
২০১৮ সালে প্রথম এ বিষয়ে নিজের গবেষণা প্রকাশ করেন ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অফ বোর্দ্যুর প্রত্নতত্ত্বের গবেষক ফনশেস্কো দেরিকো।
তিনি জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বেশিরভাগই শিল্পকর্ম বলে মনে করা হলেও এই হাড়ের টুকরোটি অন্যরকম বলে মনে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। এটি তৈরির কোনো উদ্দেশ্য ছিল বলে ধারণা তাদের।
রোমের দক্ষিণে প্রাগৈতিহাসিক একটি গুহায় মিলেছে ৯ নিয়ানডারথালের দেহাবশেষ। ছবি: এএফপি
দেরিকো বলেন, ‘ধারণা করা হয় যে হাড়ের টুকরোটিতে কোনো সাংখ্যিক তথ্য লিপিবদ্ধ ছিল। যদি এ ধারণা সঠিক হয়, তার মানে হলো শারীরিকভাবে আধুনিক আজকের মানুষই শুধু সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত নয়।
নিয়ানডারথালদের মধ্যেও গণনার এ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।’
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভল্যুশনারি অ্যান্থ্রপোলজির বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী রাসেল গ্রে জানান, সংখ্যার উৎস নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ প্রায় নেই বললেই চলে।
এমনকি সংখ্যা কী, সে বিষয়েও একমত নন বেশিরভাগ গবেষক।
তবে ২০১৭ সালের এক গবেষণায় সংখ্যার একটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, সংখ্যা হলো মূর্ত বা অস্তিত্বশীল বস্তুর সঠিক মান নিরূপণে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত বর্ণ, শব্দ ও সাংকেতিক চিহ্ন।
এখন বিভিন্ন খাতে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা নিজ নিজ অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন সংজ্ঞা দেয়ায় এবং পৃথক গবেষণার ক্ষেত্রে বিষয়টি সমস্যা সৃষ্টি করায় সংখ্যার উৎস নিয়ে অনুসন্ধানের আগ্রহ ও প্রয়োজন বাড়ছে।
পৃথিবীতে সংখ্যার আবির্ভাব নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা দলকে চলতি বছর এক কোটি ইউরোর তহবিল দিয়েছে ইউরোপীয় রিসার্চ কাউন্সিল।
সংখ্যা সহজাত প্রবৃত্তির অংশ
এক সময় গবেষকরা ভাবতেন, পরিমাণ নিয়ে ধারণা প্রাণীজগতে একমাত্র মানুষের মধ্যেই আছে।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গবেষণায় বেরিয়ে আসে, অনেক প্রাণীর মধ্যেই এই ক্ষমতা আছে। যেমন মাছ, মৌমাছি, সদ্য জন্ম নেয়া মুরগী মুহূর্তেই চার পর্যন্ত যেকোনো সংখ্যা চিনতে পারে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এ দক্ষতার নাম ‘সাবটিজিং’।
কিছু প্রাণীর মধ্যে এ দক্ষতার পরিসর আরও বড়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন সংখ্যার দিক থেকে দৃশ্যমান পার্থক্য আছে এমন দুটি বস্তুর সেই পার্থক্যও বুঝতে পারে তারা।
যেমন ১০টি ও ২০টি বস্তুর দুটি ভাগের পার্থক্য করতে পারবে এসব প্রাণী। কিন্তু ২০টি বস্তুর সঙ্গে ২১টির পার্থক্য নিরূপণ করতে পারবে না।
কোনো সংস্কৃতি বা ভাষার সংস্পর্শে না আসা ছয় মাস বয়সী মানবশিশুর মধ্যেও এ দক্ষতা বিদ্যমান।
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ তুবিঙ্গেনের স্নায়ুবিজ্ঞানী আন্দ্রিয়াস নিদার বলেন, সহজাতভাবেই সংখ্যা চেনে মানুষ। দিনে দিনে প্রাকৃতিকভাবে এটি দক্ষতায় পরিণত হয়।
আবার অনেক গবেষক মনে করেন, অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে সীমিত পরিসরে এ গুণ থাকলেও মানুষের এ গুণ অনেক বেশি পরিশীলিত। এর পুরোটা প্রাকৃতিক অর্জন নয়।
সাংস্কৃতিক বিবর্তন, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ কিংবা অন্যের কাছ থেকে শেখার মাধ্যমে সাংকেতিক চিহ্ন ও মৌখিক শব্দে সংখ্যা প্রকাশ ও উপস্থাপন করতে শেখে মানুষ।
পরিশিলীত চর্চার মাধ্যমে সংখ্যার উদ্ভব
ফ্রান্সের লে ফারদেলে ৭০’র দশকে যে হাড়ের টুকরোটি পাওয়া গেছে, সেটিই একমাত্র নয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার একটি গুহাতেও প্রায় ৪২ হাজার বছর আগের একটি বেবুনের উরুর হাড়ের টুকরো পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সেটিতেও খাঁজ কাটা।
গবেষকদের ধারণা, অঞ্চলটিতে আধুনিক মানুষের উত্থান শুরুর পর সংখ্যার হিসাব রাখতে তারাও হাড় ব্যবহার করতেন।
বেবুনের হাড়টির অনুবীক্ষণিক বিশ্লেষণ করে তাতে চারটি ভিন্ন বস্তু দিয়ে তৈরি ২৯টি খাঁজ মিলেছে। এর অর্থ হলো, চারটি ভিন্ন ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে সেটি।
সম্পত্তি গণনা
ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডোর প্রত্নতাত্ত্বিক ক্যারেনলেগ ওভারম্যান ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৩৩টি সমসাময়িক শিকারী গোষ্ঠীর তথ্য তুলনা করে দেখিয়েছেন।
তিনি আবিষ্কার করেছেন, সরল সংখ্যা পদ্ধতি অর্থাৎ চার ও এর কম সংখ্যা দেখা যেতো হাতে গোণা কয়েকটি বস্তুগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে। যেমন অস্ত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি। যেসব গোষ্ঠীর মধ্যে এর চেয়ে বড় সংখ্যা দেখা যেতো, তারা তুলনামূলক ধনী ছিল।
ওভারম্যানের মতে, জটিল সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে তখনকার সমাজ বা গোষ্ঠীকে অধিক এবং নানারকম বস্তুগত সম্পত্তির অধিকারী হতে হতো।
ওভারম্যান জানান, বেশিরভাগ গোষ্ঠীই ৫-ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করতো। অর্থাৎ হাতের আঙুল থেকেই গণনা শুরু করত তারা।
এর বেশি গোণার দরকার হলে নতুন নতুন পদ্ধতির প্রচলন ঘটাতো তারা। দিনে দিতে গণনার সুবিধার্থে তাদের মধ্যে কাঠির ব্যবহার শুরু হয়। নীল নদের অববাহিকায় প্রাচীন মেসোপ্টেমিয়া সভ্যতায় এর প্রমাণ মেলে।
বলা হয়, সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে গণনার সুবিধার্থে মেসোপ্টেমিয়ার মানুষ কাদায় তৈরি টোকেন ব্যবহার করত।