মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় বিপর্যয় ধরা হয় চেরনোবিল দুর্ঘটনাকে। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে ইউক্রেইন) চেরনোবিল শহরের পারমাণবিক কেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরের বিস্ফোরণ ডেকে আনে ভয়াবহ সেই বিপর্যয়। এর প্রভাব পড়ে ওই অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতির ওপর।চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রের ৪ নম্বর রিঅ্যাক্টরের বিস্ফোরণে প্রত্যক্ষ হিসেবে শখানেক মানুষ মারা গেলেও পরোক্ষভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে নিহত হন এর কয়েক গুণ বেশি। বিস্ফোরণের এক সপ্তাহের মধ্যেই খালি করে ফেলা হয় চেরনোবিল ও আশপাশের এলাকা। সরিয়ে আনা হয় শহরে বসবাসকারী সবাইকে।
পরমাণু বিশেষজ্ঞরা জায়গাটিকে পরবর্তী ২৪ হাজার বছর মানুষ বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করেন। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ঘোষণা করা হয় পারমাণবিক কেন্দ্রকে ঘিরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকাকে।তারপর থেকে চেরনোবিল এক্সক্লুশন জোন সেভাবেই পড়ে আছে। ধীরে ধীরে তেজস্ক্রিয়তা কমে আসায় প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে তার পুরনো রূপ। ফেলে আসা দোকানপাট, স্কুলঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো ঢেকে গেছে বুনো লতাপাতা ও গাছে।
তিন দশক পর জায়গাটিতে ধীরে ধীরে বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। পাঁচ বছর আগে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘চেরনোবিল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ’। ইউক্রেইনের কর্মকর্তারা চাইছেন এলাকাটিকে যেন ইউনিসকো সংরক্ষিত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো চেরনোবিলের পরিত্যক্ত শহর ও এর আশেপাশের বনভূমিতে বাড়ছে বুনো ঘোড়ার সংখ্যা। এল্ক হরিণ, নেকড়ের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সংখ্যাবৃদ্ধি হচ্ছে বিশেষ প্রজাতির পারসেওয়ালস্কি ঘোড়ার।রুশ বিজ্ঞানী নিকোলাই পারসেওয়ালস্কির সম্মানে নামকরণ করা এই বুনো ঘোড়াগুলোর উৎপত্তি মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমি, চীন ও আশেপাশের এলাকায়। অতি শিকারের কারণে বিংশ শতাব্দীর মাঝের দশকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে এই ঘোড়ার প্রজাতি।১৯৯৮ সালে চেরনোবিল এলাকায় ৩০টি পারসেওয়ালস্কি ঘোড়া ছেড়ে দেয়া হয়। সংরক্ষণবিদদের লক্ষ্য ছিল চেরনোবিলের বিলুপ্ত হওয়া তারপান ঘোড়ার জায়গা নেবে এগুলো।
চেরনোবিল ও তার আশপাশে বিচরণ করছে দেড় শ পারসেওয়ালস্কি ঘোড়া। ছবি: এএফপিসফল হয় তাদের উদ্দেশ্য। ২৩ বছর পর চেরনোবিল ও তার আশপাশে বিচরণ করছে দেড় শ পারসেওয়ালস্কি ঘোড়া। বেলারুশ এলাকার নো ম্যানস ল্যান্ডে আছে আরও ৬০টি।চেরনোবিল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের জ্যেষ্ঠ গবেষক সার্গিই জিলার মতে, ‘সঠিক পরিবেশ পেলে এই সংখ্যা ৩০০ এমনকি ৫০০তেও পৌঁছাতে পারে।’চেরনোবিলে বুনো ঘোড়ার এই প্রজাতির সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানে আরও বেশ কিছু বিপন্ন প্রজাতিকে ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছেন এখন বিশেষজ্ঞরা।চেরনোবিল বায়োস্ফিয়ারের প্রধান ডেনিস ভিশনেভস্কির মতে, বিলুপ্তপ্রায় ইউরোপিয়ান বাইসনও এখানে নিরাপদে বংশবিস্তার করতে পারবে।‘মানুষের বসবাসের ফলে প্রকৃতি ধ্বংস হওয়ার আগের অবস্থায় ফেরাতে পারব এলাকাটিকে’, আশাবাদ ভিশনেভস্কির।