পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণীর নাম কী- এমন প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবার জানা। সাগরতলের স্তন্যপায়ী অতিকায় এই নীল তিমির নাম আমরা সবাই জানি। তবে যেটা শুনলে যে কেউ বিষম খেতে পারেন তা হলো, এই নীল তিমির পূর্বসূরী এক কালে ছিল অতি ক্ষুদ্রকায়, মানে ছোটখাটো এক ধরনের ‘হরিণ’ মাত্র!
বিবর্তন নিয়ে কাজ করেন এমন এক দল বিজ্ঞানী বলছেন, এখন থেকে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে এখনকার তিমির পূর্বসূরীর বসবাস ছিল ডাঙায়, আকারের দিক থেকে তখনকার অন্য সব প্রাণীর তুলনায় এরা ছিল একেবারেই ‘নগণ্য’।
চার পেয়ে সেই প্রাণীর নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ‘ইন্দোহিয়াস’। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হান্স থুইসনের আবিষ্কার করা একটি ‘ইন্দোহিয়াস’-এর ফসিল বিশ্লেষণ করে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা। থুইসনের দল কিছুদিন আগে পাকিস্তানে খুঁজে পেয়েছে এই ফসিল।
৪ কোটি ৭০ লাখ বছর আগের ওই ফসিলের দেহের গড়ন বেশ গোলগাল, দৈর্ঘ্যে এ কালের শেয়ালের মতো, সঙ্গে আছে লম্বা লেজ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তিমি বর্গভুক্ত জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (যাদের মধ্যে জলহস্তিও অন্তর্ভুক্ত) উদ্ভবের ‘মিসিং লিংকটি’ হচ্ছে এই ‘ইন্দোহিয়াস’।
ডারউইনের সময় থেকেই বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, তিমির মতো জলজ স্তন্যপায়ীদের পূর্বসূরী কোনো এক কালে বিচরণ করত মাটিতে, তবে এর পরিচয়টি এতদিন ছিল এক রহস্য।
থুইসেন ও তার দল ‘ইন্দোহিয়াস’ ফসিল আবিষ্কারের পর এই রহস্যের সমাধান হয়েছে বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা।
থুইসেন বলছেন, স্থলের শিকারিদের এড়াতে মাটি থেকে জলবাসী হতে থাকে ইন্দোহিয়াসেরা। একপর্যায়ে এরা স্থলভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে জলজ জীবনধারায় অভিযোজিত হয়।
খুঁজে পাওয়া ফসিলটির বিশ্লেষণে ইন্দোহিয়াস ও তিমির খুলি এবং কানের সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। ইন্দোহিয়াসের কঙ্কালের হাড়ের বাইরের দিকে একটি পুরু স্তর ছিল। এই বৈশিষ্ট্য এ সময়ের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।
বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, শরীরের আকৃতির তুলনায় ইন্দোহিয়াসের হাড় বেশ ঘন ও ওজনে ভারী, এ কালের জলহস্তির হাড়ের মতোই। এই বৈশিষ্ট্য পানিতে থাকার সময়ে প্রাণীটিকে স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দিত।
‘ইন্দোইয়াস’-এর হাড়ের বৈশিষ্ট্য এ কালের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতোতিমির মতোই ইন্দোহিয়াসের মাথার ঠিক ওপরের দিকে ছিল দুটি অক্ষিকোটর। পুরাকালের এই প্রাণীর জলজ অভিযোজনের বিষয়টি দাঁতের রাসায়নিক গঠন থেকেও নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেছে, আর সব জলজ প্রাণীর দাঁতের মতোই সমান অনুপাতের অক্সিজেন আইসোটোপ রয়েছে ইন্দোহিয়াসের দাঁতে। এতে পরিষ্কার, এই প্রাণীর বেশিরভাগ সময় কাটত পানিতে।
থুইসেন বলছিলেন, ‘কোটি কোটি বছর আগে জলচর ইন্দোহিয়াসেরা সম্ভবত পানিতে গা ভাসিয়ে শিকারের অপেক্ষায় থাকত, এখনকার দিনের কুমির যেভাবে ভেসে থাকে।’
ইন্দোহিয়াস কী খেত, সেটিও বোঝার চেষ্টা করেছে থুইসেনের দল। স্থলচর ও জলচর প্রাণীর দাঁতে কার্বন ও অক্সিজেনের বিন্যাসের তফাৎ রয়েছে। দুই ধরনের প্রাণীর খাবার ও পানীয়র কার্বন ও অক্সিজেনের বিন্যাস আলাদা হওয়াই এর মূল কারণ।
সাগরের তিমির তুলনায় ইন্দোহিয়াসের দাঁতে উচ্চমাত্রায় কার্বন- ১৩ আইসোটোপ রয়েছে, এর অর্থ হলো প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণী স্থলের লতাগুল্মও খেত। গবেষক দলটি বলছে, ইন্দোহিয়াসের খাদ্যাভ্যাসের বিস্তারিত জানতে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে, তবে দাঁতের গঠনে বোঝা যাচ্ছে এটি পুরোপুরি স্থলের লতাগুল্মনির্ভর প্রাণীও ছিল না।
ফসিল বিশ্লেষণের ভিত্তিতে থুইসেন মনে করছেন, মূলত স্থলের শিকারি প্রাণী থেকে রক্ষার তাগিদেই ইন্দোহিয়াস পানির জীবন বেছে নিয়েছিল, প্রথম পর্যায়ে জলজ খাবার সংগ্রহ এই অভিযোজনের লক্ষ্য ছিল না। তবে অনেক পরে এর খাদ্যাভ্যাস পুরোপুরি পানিনির্ভর হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তিমির প্রথম পূর্বসূরীর উদ্ভব ঘটেছিল এখন থেকে ৪ কোটি ২০ লাখ থেকে ৪ কোটি ৮০ লাখ বছর আগে। এরপর ৪ কোটি ১০ লাখ বছর আগে এখনকার হাম্পব্যাকস ও নীল তিমির পূর্বসূরী বালেন তিমির উদ্ভব হয়। আর সাগরের বুকে এখনকার আকৃতির বিভিন্ন তিমির উদ্ভব ঘটতে শুরু ৭০ লাখ বছর আগে।