শুক্রের বায়ুমণ্ডলে প্রাণের সম্ভাব্য সন্ধান পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাদের আভাস, গ্রহটির সালফিউরিক এসিডে ভরা মেঘমালায় থাকতে পারে অদ্ভুত এক অণুজীব।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ন্যাচার অ্যাস্ট্রোনমিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে স্থাপিত দুটি টেলিস্কোপে শুক্রের ঘন মেঘে ফসফাইনের রাসায়নিক উপস্থিতি ধরা পড়ে। ফসফাইন এক ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস, পৃথিবীতে যার একমাত্র যোগ প্রাণের সঙ্গে।
গবেষণাপত্রের লেখক ও অন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ফসফাইনের উপস্থিতি উৎসাহব্যাঞ্জক। তবে এটি অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের প্রথম প্রমাণ থেকে অনেক দূরের বিষয়। তারা মনে করছেন, এ আবিষ্কার 'অসাধারণ দাবির স্বপক্ষে অসাধারণ প্রমাণ দরকার' মানদণ্ডের প্রতিফলন নয়। এই মানদণ্ডের কথা বলেছিলেন প্রয়াত কার্ল সাগান, যিনি ১৯৬৭ সালে শুক্রে প্রাণের সম্ভাব্য অস্তিত্ব নিয়ে জল্পনা করেছিলেন।
গবেষণাপত্রের সহ-রচয়িতা ও লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড ক্লিমেন্টস বলেন, 'এটি (ফসফাইনের উপস্থিতি) কোনো অকাট্য প্রমাণ নয়। এটি আপনার মূল সন্দেহভাজনের হাতে গুলির অবশিষ্টাংশও নয়। তবে বাতাসে বারুদের বিশেষ গন্ধ আছে যা কোনো কিছুর পক্ষে বলতে পারে।'
চেনা সৌরজগতের বাইরে অন্য গ্রহগুলোতে প্রাণের সন্ধান চালানো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি হলো রাসায়নিক উপস্থিতি খোঁজা। বায়োসিগনেচার নামের জৈবিক প্রক্রিয়াতেই কেবল রাসায়নিক উপস্থিতি সম্ভব হতে পারে।
প্রাণের সন্ধানের অংশ হিসেবে হাওয়াইয়ের একটি বারে বসে তিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ শুক্রে রাসায়নিক উপস্থিতির খোঁজ করেন। তারা ফসফাইনের সন্ধানে নামেন, যেটি মূলত তিনটি হাইড্রোজেন ও একটি ফসফরাস কণা।
গবেষণাপত্রের রচয়িতারা জানান, পৃথিবীতে মাত্র দুটি উপায়ে ফসফাইন গঠন হতে পারে। এর একটি শিল্প প্রক্রিয়ায়। এর উদাহরণ হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক যুদ্ধের উপকরণ হিসেবে ফসফাইন গ্যাস উৎপাদন।
বিভিন্ন প্রাণী ও অণুজীবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফসফাইন উৎপাদিত হয়। কিছু বিজ্ঞানী এ গ্যাসটিকে উচ্ছিষ্ট হিসেবে গণ্য করেন। তবে অন্যরা তা মনে করেন না।
এ বিষয়ে গবেষণাপত্রের সহ-রচয়িতা ক্লিমেন্টস বলেন, পুকুরের তলদেশে কাদায় ফসফাইন পাওয়া যায়। নিশাচর প্রাণী ব্যাজারের অন্ত্রেও এটির দেখা মেলে। এ ছাড়া পেঙ্গুইনের বিষ্ঠাতেও ফসফাইন পাওয়া যায়।
গবেষণাপত্রের আরেক সহ-রচয়িতা ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) গ্রহবিজ্ঞানী সারা সিগার বলেন, বিজ্ঞানীরা ফসফাইন গঠনের সম্ভাব্য সবগুলো কারণ (অগ্ন্যুৎপাত, বজ্রাঘাত, বায়ুমণ্ডলে ছোট উল্কাপিণ্ডের পতন) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কিন্তু তাদের অনুমিত কোনো প্রক্রিয়াতেই ব্যাপক পরিমাণে ফসফাইন উৎপাদিত হওয়া সম্ভব নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শুক্রে (যেখানে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও কোনো পানি নেই) কীভাবে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে, তার একটি চিত্র কল্পনা করেছেন। এ বিষয়ে ক্লিমেন্টস বলেন, 'শুক্র নরকসম। শুক্র পৃথিবীর অশুভ যমজের মতো।' তিনি আরও বলেন, 'নিশ্চিতভাবেই শুক্রে বাজে থেকে বাজেতর কিছু ঘটেছে। এটা নিয়ন্ত্রণহীন গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ার শিকার।'
ক্লিমেন্টসের মতে, গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া হতে পারে শুক্রের পৃষ্ঠে।
সিগার ও ক্লিমেন্টস বলেন, কিছু অণুজীবের মাধ্যমে সালফিউরিক এসিড ড্রপলেটে (ক্ষুদ্র জলীয় কণা) ফসফাইন উৎপন্ন হতে পারে। অণুজীবগুলো সম্ভবত এককোষী। এগুলো পুরো জীবন কাটায় ১০ মাইল গভীর মেঘমালায়।
তারা আরও বলেন, ড্রপলেটগুলো পড়ে গেলে সম্ভাব্য প্রাণ হয়তো শুকিয়ে যায়। পরে শুকিয়ে যাওয়া বস্তুটি অন্য কোনো ড্রপলেটে গিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়।
গবেষণাপত্রের রচয়িতাদের বাইরে অন্য কিছু বিজ্ঞানী বলেছেন, প্রাণের অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে একটি সম্ভাবনা। তবে এখনো অনেক প্রমাণ দরকার।