বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গৃহশ্রমিকের সুরক্ষা নীতির অস্তিত্ব কেবল কাগজে, পাইলট প্রকল্প ঘিরে সংকট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক    
  • ২০ আগস্ট, ২০২৫ ১৪:২৪

গৃহশ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য সরকার নীতি প্রণয়ন করলেও ১০ বছরে বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ প্রবচনের মতোই নীতিমালা রয়ে গেছে মলাটবন্দি। এমনকি নিয়োগকর্তা থেকে শুরু করে গৃহশ্রমিকদের প্রায় কারও জানা নেই এসব নীতি। ফলে কোনো হেরফের ঘটেনি দেশের সবচেয়ে অবহেলিত এ পেশায়। বেসরকারিভাবে কিছু পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও এক বছর ধরে সেখানেও চলছে সংকট।

গৃহশ্রমিকের কাজের পরিবেশ, মজুরি, ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘গৃহকর্মী কল্যাণ ও সুরক্ষা নীতি’ অনুমোদন দেয় সে সময়কার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা। এরপর ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি জারি হয় গেজেট।

গৃহশ্রমিকের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে মজুরি, কর্মঘণ্টা, নিয়োগত্রের ব্যবহার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উপায়, সরকারের দায়িত্ব ও তদারকি সেল গঠন, গৃহকর্মী-নিয়োগকর্তা-সরকারের দায়িত্বসহ অনেকগুলো দিক সুনির্দিষ্ট রয়েছে নীতিমালায়। তবে এক দশকেও এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটেনি। গেজেট পেপারের ছাপার অক্ষরেই আটকে আছে নীতিমালা। আগের মতোই চলছে গৃহ শ্রমিক নির্যাতন। তাদের জন্য নির্ধারণ হয়নি মজুরি কাঠামো এবং কর্মঘণ্টা, এমনকি পেশা হিসেবেও বাস্তব পরিসরে স্বীকৃতি পায়নি গৃহশ্রম।

মানবাধিকার ও গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এবং বিশ্লেষকেরা এর জন্য দায়ী করছেন সরকারের সদিচ্ছাকে। পাশাপাশি আরও কিছু প্রতিবন্ধকতাও সামনে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, আইনের বাধ্যতামূলক প্রয়োগ না থাকা, তদারকি ব্যবস্থাপনার অভাব, গৃহশ্রমিকদের সক্রিয় সংগঠনের অপ্রতুলতা, অধিকার নিয়ে প্রচার এবং সচেতনতার অভাব এবং তীব্র শ্রেণিবৈষম্য প্রতিকূল পরিস্থিতি বজায় রাখতে ভূমিকা রাখছে।

সরকারিভাবে প্রচারের অভাবে নিয়োগকর্তা এবং গৃহশ্রমিকদের প্রায় কেউই নীতিমালার বিষয়টি জানেন না। এজন্য সরকারের আন্তরিকতাকেই দায়ী করছেন গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক-এর সমন্বয়কারী আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ’যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে সরকার ব্যপক প্রচার চালাবে সেটাই নিয়ম। স্বাস্থ্যসেবা এমনকি সচেতনতামূলক যেকোনো বিষয়েই আমরা নিয়মিত পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিওতে সরকারি ক্যাম্পেইন দেখতে পাই। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে গৃহকর্মী কল্যাণ ও সুরক্ষা নীতি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রচার নেই।’

তিনি বলেন, ‘এখন তো স্যোশাল মিডিয়ার যুগ। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। এখন চাইলে প্রচার চালানো অনেক সহজ। সরকার চাইলেই স্যোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালাতে পারে, কিন্তু সদিচ্ছা নেই বলে তা হচ্ছে না।’

তবে এ অভিযোগ মানতে রাজি নয় শ্রম অধিদপ্তর। এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহ্ আবদুল তারিক দাবি করছেন, নীতিমালাটি অনুমোদনের পর থেকেই প্রচার করা হচ্ছে। জনসাধারণকে সচেতন করতে তারা বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছেন। কীভাবে প্রচার চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নীতিমালাটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে দেশের প্রতিটি বিভাগ এবং জেলায় আলাদা আলদা কমিটি করা হয়েছে। তারা লিফলেট বিতরণসহ যখন যেমন প্রয়োজন তেমন প্রচার চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আলাদা করে নির্দেশনা দেয়া আছে। তারা তাদের আওতাধীন এলাকার বাসাবাড়ির গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি তদারকি করেছেন।’

তবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন নিয়োগকর্তা এবং গৃহশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে তাদের কেউ নীতিমালা সম্পর্কে জানেন না। স্থানীয় থানাও এ বিষয়ে কোনো তদারকি করছে না। বিষয়টি তুলে ধরে সংবাদমাধ্যম, স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচার চালানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে শ্রম অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘স্যোশাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন চালানোর বিষয়টি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। আমরা সংবাদমাধ্যম এবং স্যোশাল মিডিয়াকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি তা নিয়ে অবশ্যই পরবর্তী মিটিংয়ে আলোচনা করব।’

ক্ষমতার পালাবদলে সংকটে পাইলট প্রকল্প

গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারি উদ্যোগের অভাবের মধ্যেও কিছু পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় নাগরিক সংগঠনের অংশগ্রহণে জনপরিসর সম্প্রসারণ ও সুশাসন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ (এক্সপ্যান্ডিং সিভিক স্পেস থ্রু অ্যাক্টিভ পার্টিসিপেশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেন গভার্নেন্স সিস্টেম ইন বাংলাদেশ- ইসিসেপ) নামে চলছে এমনই একটি প্রকল্প। নারী গৃহশ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, তাদের জন্য সম্মানজনক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শোষণ ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেয়া এবং মর্যাদা ও সামাজিক স্বীকৃতি বাড়াতে সম্মিলিতভাবে প্রকল্পটি পরিচালনা করছে ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর আওতায় ‘নারী মৈত্রী’ নামের একটি সংগঠন গৃহশ্রমে নিয়োগপত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে গৃহশ্রমিক ও নিয়োগদাতাদের মাঝে প্রচার চালাচ্ছে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় পাঁচজন নারী গৃহশ্রমিক নিয়োগপত্র পেয়ে উদাহরণও সৃষ্টি করেছেন। নিয়োগপত্রটি এমনভাবে তৈরি যেখানে উভয়পক্ষের স্বার্থ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সেই সঙ্গে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে প্রতি মাসের বেতন যায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সেটি সম্ভব না হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন দিতে নিয়োগদাতাদের উৎসাহিত করা হয়।

আমরাই পারি জোটের এই উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পে রাজধানীর মোহম্মদপুর, কল্যাণপুর এবং শের-ই-বাংলা নগর এলাকার সাড়ে তিন হাজার এবং কামরাঙ্গীরচর এলাকায় আড়াই হাজার গৃহশ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করেছে নারী মৈত্রী ও সহায়ক দুটি সংস্থা। অন্তত এক লাখ মানুষের মাঝে গৃহশ্রমিকের অধিকার ও নির্যাতন প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে সংগঠনগুলো। পাশাপাশি গৃহশ্রমিকের দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদের গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজ শেখানোর পাশাপাশি ঘরে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্র যেমন ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, ইলেক্ট্রিক চুলা, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদি ব্যবহারের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে।

প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো গৃহশ্রমিকের মধ্যে একতা তৈরি করা এবং সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের একটি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পটির সামনে তৈরি হয়েছে চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকা এবং নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হতে যাওয়া প্রকল্পটির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ নাও করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গৃহশ্রমিকের মাঝে একতার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করাকে প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী দিক হিসেবে বিবেচনা করছেন নারী মৈত্রীর ট্রেইনিং কো-অর্ডিনেটর নাহিদ সুলতানা। তবে মাঠ পর্যায়ে গত এক বছরে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ার কথা জানান তিনি।

নাহিদ সুলতানা বলেন, ’আমরা চাইছি গৃহকর্মীদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকুক, যাতে তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারেন। এজন্য আমরা এরিয়াভিত্তিক ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে তাদের একেক জন নেতা নির্বাচন করার চেষ্টা করছি। তবে সমস্যা হলো এখানে রাজনৈতিক প্রভাব আছে। আগে দেখা গেছে যারা একটি রাজনৈতিক দলের মিটিং মিছিলে যেতেন তারা এখন কোণঠাসা। এখন যারা অন্য দলের মিটিং মিছিলে যাচ্ছেন তারা তাদের কমিউনিটিতে ভালো অবস্থায় আছেন। যার নেতৃত্বগুণ ভালো এমন একজনকে আমরা একটি গ্রুপের লিডার নির্বাচিত করলাম, কিন্তু দেখা গেল তিনি হয়ত আগে একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছিলেন, তাই এখন অন্য দলের অনুসারীরা তার নেতৃত্ব মানছেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে এমনও হচ্ছে, আগের রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের একজন লিডারের তার কমিউনিটিতে খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর কমিউনিটিতে অনুপস্থিতির কারণে তার অনুসারীদের এখন প্রকল্পে যুক্ত করা যাচ্ছে না ’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে জটিল করে তুলেছে বলেও জানান নাহিদ সুলতানা। তিনি বলেন, ‘কোনো ওয়ার্ডে কাউন্সিলর না থাকার কারণে আমাদের মাঠ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ প্রকল্পের ভালো ফল আনতে হলে নিয়োগকর্তা এবং গৃহকর্মীদের সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। আর এ কাজটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়।’

আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক মনে করেন, জনসম্পৃক্ত যেকোনো কাজের জন্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকলে তাদের অধিকার নিয়ে ভালোভাবে কাজ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে যে পাইলট প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্যই হলো- এর ফলাফলের ভিত্তিতে সরকার এবং দাতা সংস্থাগুলো যেন বড় পরিসরে কাজ করতে পারে। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদের প্রায় পুরোটা সময় ধরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গৃহশ্রমিকের সুরক্ষার জন্য পাইলট প্রকল্পটির কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। রাজনৈতির অস্থিরতার কারণে আমরা সেটি ভালোভাবে করতে পারছি না। তাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন আছে।’

এ বিভাগের আরো খবর