ভূমি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সকল কর্মকান্ডেরই মূল উৎস। জম্ম থেকে মৃত্যু সবই এ ভূমিতে, তাই মানুষের জীবন জীবিকার জন্য জমির বিকল্প কিছুই নেই। মানুষের জীবন ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও নির্ভর করে ভূমির উপযুক্ত ব্যবহারের ওপর। ভূমি মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও ভূমির ওপর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাপনা কখনই স্বচ্ছ ছিল না। অন্যদিকে ভূমির ব্যবস্থাপনা সুদীর্ঘকাল ধরে এতদঞ্চলের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মুখ্য ভিত্তি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এর ইতিহাসও বেশ প্রাচীন।
সময়ের পরিক্রমায় ভূমিসেবা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ,হয়রানী মুক্ত এবং আধুনিক হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ ও জনবান্ধব করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজড করে জনবান্ধব করা হয়েছে। হয়রানি, ভোগান্তি, দুর্নীতি ইত্যাদি বন্ধে ভূমির ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম আর্শিবাদ স্বরুপ। ভূমিসেবা একটি ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। মন্ত্রণালয় এখন ল্যান্ড সিঙ্গেল গেটওয়ে তৈরি করেছে যার মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের বিচ্ছিন্ন ডিজিটাল সার্ভিস গুলো এখন একটি জায়গায় পাওয়া যাবে।
সরকার নাগরিকদের হয়রানিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ভুল ভূমি রেকর্ড প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়েছে এবং ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজ করে জনবান্ধব করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পূর্বে ভূমি সংক্রান্ত জনগণের কাঙ্খিত সেবা তেমন নিশ্চিত হয়নি। ভূমি জঠিলতা নিরসনে প্রত্যেকটি জমির জিপিএস এবং জিও ফেন্সিং ব্যবহারের ফলে ভূমির মালিক তার জমির সব ধরনের তথ্য গুগোল আর্থে প্লট করে দেখতে পারবে। পরবর্তী স্টেজে এই জরিপের সাথে ভূমির মালিকানার একটা ম্যাপিং করা হবে। তার বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের তথ্য ,নামজারি প্রক্রিয়া এবং কোন মামলা আছে কিনা থাকলে মামলার বর্তমান অবস্থা এই সব বিষয়ে গুলো সংযুক্ত করা হবে। অর্থাৎ একটা সিঙ্গেল গেটওয়েতে বসে ভূমির ডিজিটাল ম্যাপের সাথে তার মালিকানাসহ বর্তমান অবস্থা দেখা যাবে।
বিদ্যমান সফটওয়্যার গুলোর আপডেট করাসহ জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য গত ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে পরিক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত (লইভ) করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে ইন্টারনেট সেবা সংক্রান্ত দপ্তরসমুহে ফ্যাসিস্ট সরকারের চক্রান্তে কৃত্তিমভাবে প্রস্তুত একটি বন্ধুরপথ অতিক্রম করে আজ ভূমিসেবায় আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
ভূমিসেবা নেওয়ার জন্য এখন আর ভূমি অফিসে সশরীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজস্ব মোবাইল নম্বর দিয়ে অনলাইনে আবেদন পরবর্তী জমির নামজারি হলেই ভূমি মালিক ঘরে বসেই পর্চা বা খতিয়ান সংগ্রহের পাশাপাশি অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পারবে। অনলাইনে ভূমির খাজনা দেওয়া, নামজারি, জমাখারিজ,খতিয়ান বা পর্চা সার্টিফাইড কপি ও মৌজা ম্যাপ বা ভূমি উন্নয়ন কর অনলাইনে হচ্ছে। ফলে সহজেই অনলাইনে এসব সেবা গ্রহণ করতে পারছে সেবাগ্রহীতাগণ। এতে সময়, শ্রম এবং খরচ সবই সাশ্রয় হচ্ছে।
ভূমিসেবা পুরোপুরি হয়রানি,ভোগান্তিমুক্ত ও জনবান্ধব করতেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রবেশ। দেশে বিদেশে যেকোনো স্থান থেকে ঘরে বসে বা কলসেন্টারের মাধ্যমে এসব সেবা গ্রহণ করা যাচ্ছে। ভূমি সেবা ডিজিটালি হওয়াতে কেউ ইচ্ছে করলেই ভূমি মালিকদের হয়রানি করার সুযোগ নেই। সরকার চাচ্ছে জনগণের মূল্যবান সময় ও অর্থকড়ি বাচিয়ে তাদের ঘরে সেবা পৌঁছে দেওয়া।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সরাসরি 09612316122 নম্বরে ফোন করে অথবা ভূমিসেবা পোর্টাল অথবা "ই-খতিয়ান" মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি আবেদন করে খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপের সত্যায়িত কপি নিজ নিজ ঠিকানায় জনগণ পেয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে যেকোন সময় (২৪/৭) যেকোন নাগরিক এখন ভূমি অফিসে না এসেই নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর এবং খতিয়ান সেবা গ্রহণ করতে পারছেন কলসেন্টার ও নাগরিক ভূমিসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় স্থাপিত ভূমি ভবনের নিচতলায় নাগরিক ভূমি সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ভূমি ভবন থেকে ১৬১২২ নম্বরে ফোন করে অথবা ভূমিসেবা পোর্টাল land.gov.bd অথবা “ভূমি উন্নয়ন কর” মোবাইল অ্যাপ-এর মাধ্যমে ঘরে বসেই এনআইডি নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। কর পরিশোধের সাথে-সাথে নাগরিকগণ তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইনে কিউআর কোড-সমৃদ্ধ একটি দাখিলা প্রাপ্ত হচ্ছেন যা ম্যানুয়াল পদ্ধতির দাখিলার সমমানের এবং সর্বত্র গ্রহণযোগ্য।
যাদের জমি জমা নিয়ে জটিল সমস্যা রয়েছে তাদের প্রতিবছর মে মাসে ভূমি সেবা সপ্তাহে বা ভূমি মেলায় ও ভূমি অফিসেগুলো আগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের সেবা দেয়া হয়। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সব ভূমি অফিস প্রতি বছর মে মাসে ভূমি সেবা সপ্তাহ বা মেলায় শুধু সেবা প্রদান করবে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ উঠে আসবে।
মেলার মাধ্যমে জনসাধারণ সরাসরি ভূমি সেবাসমূহের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। পাশাপাশি ভূমি আইন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ এবং দুর্নীতি হ্রাসে ভূমি মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যে ভূমি সংক্রান্ত ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলাগুলো দ্রুত সমাধানের নিমিত্ত এবং ভূমিসেবাকে সহজীকরণের লক্ষ্যে (১) ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩, (২) ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২৩, (৩) ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩, (৪) হাট ও বাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০২৩, (৫) State Acquisition & Tenancy (Amendment) Act, 2023, (৬) বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সকল জলমহালের সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৪, হাট ও বাজার বিধিমালা-২০২৫, ভূমি অধিগ্রহণ বিধিমালা-২০২৫ ও ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ভূমিসেবার সাথে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) তথা পেমেন্ট গেটওয়েসহ অর্থ বিভাগের এ-চালান সিস্টেম, এর ফলে নাগরিকের অনলাইন সিস্টেমে পরিশোধিত ফি-সমূহ তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে। অনলাইন ভূমিসেবার ফলে ভূমি উন্নয়ন কর দেয়া আগের মত এখন বিড়ম্বনা নেই। আদায় হার পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে;ফলে ভূমিসেবা হতে রাজস্ব আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাদেশের ভূমিসেবাসমূহ থেকে অনলাইনে আদায়কৃত ফিসসমূহ সরাসরি ড্যাশবোর্ডে প্রদর্শিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন সরকারি কোষাগারে ভূমিসেবা ফি থেকে সরকারি কোষাগারে জমার পরিমাণ প্রায় ১০-১২ কোটি টাকা ।
হয়রানি রোধে ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমিসেবায় নতুনভাবে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। নুতন ভাবে সব কিছু পরিবর্তন করে আপলোড হচ্ছে। ভূমি উন্নয়ন কর,নামজারি, পর্চা বা খতিয়ান ও নকশা এগুলো জনগণের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। হয়রানি ব্যাতীত ভূমিসেবাসমূহ স্বল্প মূল্যে ও সহজলভ্য করার হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কর শুধু সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করেনা, যারা ভূমি উন্নয়ন কর দেন তারা একটা দাখিলা পান এবং এটি মালিকানার জন্য প্রয়োজন যা এক প্রকার দলিল ও ভূমির সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
কোনো প্রকার দালাল বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নয়, জনগণ যেন সরাসরি অফিসে এসে সেবা গ্রহণ করবে। কোনো ধরণের হয়রানি, ভোগান্তি ও দুর্নীতি ছাড়াই জনগণের কাঙ্খিত ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। ভূমিসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে কেউ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে সে বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদেরকে স্বচ্চতা ও দক্ষতার সাথে কাজ করার মন মানসিকা অপরিহার্য। সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহীতার স্তর রাখা হয়েছে। ২৮ দিনের উর্ধেব কোন নামজারি বিশেষ কারণছাড়া পেন্ডিং রাখা যাবে না। একই সাথে সকল পেন্ডিং ডিসিআরের জন্য এক্সেল তালিকা হতে নাগরিককে ফোন করে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করতে হবে। কোন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কোন নাগরিকের আবেদন পেন্ডিং রাখবেন না। এ বিষয়ে সকল মনিটরিং কর্মকর্তা নিয়োমিত মনিটরিং করবেন।
ভূমি সেবা নিশ্চিত করতে জিরো টলারেন্স নীতিতে সরকার। ভূমির বিষয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয় জেলা প্রশাসকদের ওপর। সেজন্য সরকারের নীতি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছেন ভূমি উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিব মহোদয়। মন্ত্রণালয় স্থানীয়ভাবে সরাসরি পরিদর্শনের মাধ্যমে নজরদারি করছে। এছাড়া ইউএনও ও এসিল্যান্ডরাও সরাসরি ভূমিসেবার সাথে যুক্ত রয়েছেন। জনগণের কাছ থেকে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধিমতে ব্যবস্থা গ্রহণও করা হবে।
২০২৬ সাল নাগাদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিকগণকে খুব প্রয়োজন ছাড়া যেনো ভূমি অফিসে যেতে না হয়। এনআইডি দিয়েই যাতে ভূমির সকল তথ্য পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা। আইবাসের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভূমি ডাটা ব্যাংক থেকে স্বয়ংক্রিয় তথ্যের মাধ্যমে ভূমি কর্মকর্তাদের সরকারি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন রহিতকরণ । খতিয়ান ও ম্যাপ অটো কারেকশনের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ করা হবে। ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়ের (এলএসজি) মাধ্যমে নাগরিকের প্রোফাইল তৈরি। লীজ ও সেটেলমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সায়রাত মহাল ব্যবস্থাপনা। রাজস্ব মামলা ব্যবস্থাপনাসহ সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি রক্ষা। সর্বপরি জনবান্ধব ভূমিসেবা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অঙ্গিকার।