পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের ভাবনা ও কল্পনা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ছিল। ধর্ম ও পুরানে এর সমর্থনে নানা কাহিনি প্রচারিত থাকলেও ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী বা কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব মানুষ এখনো নিজের চোখে দেখেনি। তবে যুগে যুগে মহাবিশ্বে প্রাণের খোঁজে বিজ্ঞানীদের চলছে নিরলস গবেষণা। বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিন দিন উন্নতি এবং মহাকাশ ও গ্রহ-নক্ষত্র ঘিরে এ গবেষণা আরও জোরালো হচ্ছে। সম্প্রতি একটি গবেষণা এ বিষয়ে জুগিয়েছে আশার আলো। পৃথিবী থেকে ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত লিও নক্ষত্রমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রহের নাম ‘কে২-১৮বি’। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৮.৬ গুণ ভারী ও আকারে ২.৬ গুণ বড় এই গ্রহটি নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তারা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে জানিয়েছেন, গ্রহটিতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে তারা শক্তিশালী প্রমাণ পেয়েছেন। তবে বিষয়টি কেবলই প্রাথমিক ধারণার পর্যায়ে আছে জানিয়ে তারা এ বিষয়ে আরও গভীর বিশ্লেষণের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবিসি বাংলা জানায়, কে২-১৮বি নামের একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। তারা গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে এমন কিছু অণুর উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন যা পৃথিবীতে কেবল সরল বা এক কোষী (উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ব্যাকটেরিয়া) জীবের মাধ্যমেই তৈরি হয়।
এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো, একইসঙ্গে আগের চেয়েও বেশি আশাব্যঞ্জকভাবে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করেছে।
তবে এই ফলাফল নিশ্চিত করতে আরও তথ্য প্রয়োজন বলে জানিয়েছে গবেষণা দলটি, স্বাধীনভাবে কাজ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও একই মত দিয়েছেন।
শিগগিরই নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক নিক্কু মধুসূদন।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিজের ল্যাবরেটরিতে তিনি জানান, ‘এটাই এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাণের অস্তিত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ। বাস্তবে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে আমরা এই সংকেত নিশ্চিত করতে পারব।’
আকারের দিক থেকে কে২-১৮বি পৃথিবীর তুলনায় আড়াই গুণ বড়। এটি আমাদের থেকে ৭০০ ট্রিলিয়ন মাইল, অর্থাৎ ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর মানে দাঁড়ায়- কোনো মানুষের পক্ষে সেখানে এক জীবনে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এতটাই শক্তিশালী যে একটি ছোট লাল সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ওই গ্রহ অতিক্রম করে আসা আলো বিশ্লেষণ করে ওই গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করতে পারে।
কেমব্রিজের গবেষক দলটি দেখেছে যে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের দুটি অণুর মধ্যে অন্তত একটির মধ্যে এমন রাসায়নিক চিহ্ন রয়েছে যেগুলো সাধারণত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত; এই রাসায়নিকগুলো হলো- ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস) এবং ডাইমিথাইল ডিসালফাইড (ডিএমডিএস)।
পৃথিবীতে এই গ্যাসগুলো সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।
একটি পর্যবেক্ষণেই এই গ্যাসের এতটা উপস্থিতি দেখে নিজের বিস্ময়ের কথা জানান অধ্যাপক মধুসূদন। তিনি বলেন, ‘বায়ুমণ্ডলটিতে যে পরিমাণ গ্যাস আছে বলে আমরা ধারণা করছি, তা পৃথিবীর চেয়ে হাজার গুণ বেশি। ফলে এই গ্যাস যদি আসলেই জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে গ্রহটিতে জীবনের প্রাচুর্য থাকবে।’
আরও এক ধাপ এগিয়ে অধ্যাপক মধুসূদন বলেন, ‘আমরা যদি কে২-১৮বি গ্রহে জীবন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি তার মানে এটাই দাঁড়াবে যে ছায়াপথে জীবন থাকাটাই স্বাভাবিক।’
গত বৃহস্পতিবার বিবিসি রেডিও ফাইভের লাইভে তিনি বলেন, ‘এটা বিজ্ঞানের জন্য এবং একাধারে প্রাণী হিসেবে আমাদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্ত। এমন যদি একটা উদাহরণ মেলে, তাহলে বুঝতে হবে- এই অসীম মহাবিশ্বে আরও অনেক গ্রহেই জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে।’