বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিয়েতে মোহরানা বা ইসলামি রীতি অনুযায়ী স্ত্রীকে প্রদেয় অর্থ নিয়ে বর ও কনেপক্ষে ব্যাপক দরকষাকষি চলে। কোনো কারণে স্বামী তালাক দিলে নিজেদের মেয়ের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কনেপক্ষ বড় অঙ্কের টাকা মোহরানা চান। বরের আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে সেটা ৫ লাখ, ১০ লাখ, ১৫ লাখ বা তার বেশি টাকাও হতে পারে। কিন্তু এত টাকা মোহরানার পরও সংসার সুখের হওয়ার গ্যারান্টি থাকে না।
স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হলে কাবিনের অর্থের জন্য অনেক সময় জোর করে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয় স্বামীর। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর অত্যাচারে স্ত্রী তালাক দিতে বাধ্য হতে পারেন। এ ধরনের বাস্তবতায় মোহরানার উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।
সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এমন রীতি বদলাতে চেয়েছেন সৈয়দ আয়েশা ফাউন্ডেশন-এর কর্ণধার সানজানা শিরিন ও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম মিস্টার ট্রাভেলার-এর প্রতিষ্ঠাতা মো. ইসমাইল শিকদার। হবিগঞ্জ ও বগুড়ার এ দুই বাসিন্দা গত ৭ জানুয়ারি বিয়ে করেছেন। হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় অনুষ্ঠিত বিয়েতে মোহরানা হিসেবে সানজানাকে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন ইসমাইল।
বর্তমানে বিয়েতে যেখানে মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন ছেলের কাছ থেকেও ৫ লাখ টাকার মতো মোহরানা দাবি করেন মেয়েপক্ষের লোকজন, সেখানে ৫ হাজার টাকায় কীভাবে বিয়ে সম্ভব হলো, তা জানতে চাওয়া হয় ইসমাইলের কাছ থেকে।
জবাবে সেন্টমার্টিন থেকে মুঠোফোনে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিয়েটা হয়েছে পারিবারিকভাবে। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ তার (সানজানা) সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার পর বিয়ের প্রস্তাবটা দিই। পরে পারিবারিকভাবে গত ৭ জানুয়ারিতে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। কম টাকায় কাবিনের প্রস্তাবটা আমার ওয়াইফের দিক থেকেই আসে।’
কম মোহরানায় বিয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে মিস্টার ট্রাভেলারের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘আমাদের সমাজে একটা টেনডেন্সি (প্রবণতা) চলে আসছে বেশি টাকা কাবিনের (মোহরানা)। মেয়েদের যেন তালাক দিতে না পারে, সে জন্য এ টাকাটা অনেকটা ছেলেদের গলায় বেড়ি পরানোর মতো। এত টাকার বিনিময়ে যেন মেয়েকে ছাড়তে না পারে।
‘কিন্তু মেয়ের সুখ-অসুখ কি এই টাকার ওপর নির্ভর করে? করে না। অনেক সময় বেশি টাকা কাবিনে বিয়ে করে বনিবনা না হলে ছেলের পক্ষ থেকে মেয়েকে টর্চার করা হয়। একপর্যায়ে মেয়ে বাধ্য হয় তার স্বামীকে তালাক দিতে। আমরা চেয়েছি এ অবস্থার বিপরীতে সমাজে একটি মেসেজে দিতে।’
বিয়েতে পাঁচ হাজার টাকা মোহরানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নেট ঘেঁটে বা এ সংক্রান্ত পড়াশোনা করে যতদূর জেনেছি, ইসলামে সর্বনিম্ন মোহরানা ১০ দিরহাম। এ অর্থ দিয়ে যে রূপা কেনা হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর দাম তিন হাজার ১০০ টাকার বেশি। আমরা সে বিষয়টি মাথায় রেখে ৫ হাজার টাকা কাবিনে বিয়ে করেছি।’
এত কম টাকা মোহরানায় বিয়ে কনেপক্ষ সহজে মেনে নিয়েছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয় সানজানার কাছে। জবাবে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি পরিশ্রমী মানুষ। জীবনে চলার জন্য যা ইনকামের দরকার হয়, তা আমি করতে পারব। আমার চিন্তা ছিল কম টাকায় কাবিন করা।
‘আমার বড় ভাই বলেছিল, এটা কীভাবে সম্ভব? আমার মা বলেছিলেন, অন্তত দুই লাখ টাকা কাবিন করতে। মুরুব্বিরা চিল্লাচিল্লি শুরু করেছিল।’
পরিস্থিতি সামলানো নিয়ে আয়েশা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘কাজিকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলি। যেহেতু আমাদের এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, সেহেতু এ টাকায় বিয়ে পরাতে কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। কাজি আমার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বিয়ে পরাতে রাজি হন।’
পাঁচ হাজার টাকা মোহরানার বিয়ের ছবিতে অনেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেদের ওয়ালে বিষয়টি শেয়ারও করেছেন। এ নিয়ে জানতে চাইলে ইসমাইল শিকদার বলেন, ‘আমরা ভাইরাল হওয়ার জন্য পোস্টটা দিইনি। আমার ওয়াইফ যেহেতু সামাজিক কাজ করেন, তার ফলোয়ারদের উদ্দেশে তিনি পোস্টটা দেন, যাতে তারা এখান থেকে অনুপ্রাণিত হন।
‘এ পোস্ট দেখে অনেকে পজিটিভ কমেন্ট করেছেন। কেউ কেউ আবার নেগেটিভ কমেন্ট করেছেন যে, আমরা ভাইরাল হতে চেয়েছি। আসলে আমাদের এমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিয়েতে শুধু কাবিনের খরচই কম করিনি; অনুষ্ঠানের অন্যান্য সব খরচই কম করেছি। জমানো টাকা থেকে পুরো আয়োজন শেষ করেছি আমরা।’
বিয়েতে মোহরানা: একজন আলেমের মত
বিয়েতে কত টাকা মোহরানা দেয়া সুন্নত, তা নিয়ে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও জনপ্রিয় আলেম শায়খ আহমাদুল্লাহ তার এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ‘মোহরানা দিবেন সামর্থ্য অনুযায়ী। যার যতটুকু তাওফিক (সামর্থ্য) আছে, ততটুকু মোহরানা দিবেন।’
তিনি বলেন, ‘শুধু মোহরে ফাতেমি (মহানবী (সা). এর মেয়ে ফাতেমা (রা.)-এর বিয়েতে যে মোহরানা ধরা হয়) খুঁজবেন না। রাসুলে করিম (সা.) সেই যুগে যদি মোহরে ফাতেমি এত টাকা দেন, এই যুগে তো আপনাকে আল্লাহ অনেক সামর্থ্য দিছে, আরও বেশি দিবেন।
‘তবে বিয়ের মধ্যে মোহরানার ফিগার খুব বেশি বড় হওয়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নাই। যে বিয়েতে খরচ কম, সে বিয়ে বেশি বরকতপূর্ণ। আমাদের সমাজে তো যে বিয়েতে মিলিয়ন মিলিয়ন খরচ হয়, মনে হয় যে, এই ব্যাটা বিয়ে করছে। আর আপনার বিয়েতে লাইট-মাইট কিছু জ্বলে নাই, হ্যায় বিয়ে করছে বলে মনে হয় না। এটা হলো শয়তান আমাদের কুমন্ত্রণা দেয়।’
এ আলেম আরও বলেন, ‘খরচ কম করবেন। সে বিয়েতে বরকত বেশি হবে। অপচয় করা এটা প্রশংসনীয় নয়। গরিব মানুষ। তাও লাইট-টাইট জ্বালানো লাগে। এগুলো ঠিক না। এগুলা নাজায়েজ কাজ; গুনাহের কাজ। এ জন্য মেয়ের বিয়েতে বা বিয়েতে মোহরানা দিবেন ছেলে তার সামর্থ্য অনুযায়ী। যত বেশি সম্ভব আপনার স্ত্রীকে অনার করবেন।’