বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জল থেকে ডাঙায় আসছেন মানতারা

  •    
  • ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০৮:৪৭

নিজেদের কোনো জমি না থাকায় নৌকায় বাস করেন মানতারা। নদীর সঙ্গে তাই এদের নিবিড় সম্পর্ক। মাছ ধরাই মানতাদের একমাত্র পেশা। সারাজীবন নদীতে ভাসতে থাকায় অনেকে এদের ‘ভাসান’ বা ‘ভাসমান’ বলেও ডাকে।

নদীর এক ঘাটে রান্না করে আরেক ঘাটে খায়। এভাবেই যুগের পর যুগ চলে আসছে জীবন। পরিবার গঠন, সন্তান পালন, জন্ম-মৃত্যু সবই নৌকায়।

বহু বছরের এই ভাসমান জীবন এবার শেষ হতে চলেছে মানতাদের। সরকারের উদ্যোগে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে এবার জল থেকে ডাঙায় বসবাস করতে আসবেন তারা।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এবার তাদের দেয়া হবে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা। এতে পাল্টে যাবে সম্প্রদায়টির জীবনধারা। স্থায়ী ঠিকানার জন্য মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে মানতাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ২৯টি পাকা ঘর।

মানতা কারা

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীতে নৌকায় বসবাস করেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের কোনো জমি না থাকায় নৌকায় বাস করেন মানতারা। নদীর সঙ্গে তাই এদের নিবিড় সম্পর্ক। মাছ ধরাই মানতাদের একমাত্র পেশা। সারাজীবন নদীতে ভাসতে থাকায় অনেকে এদের ‘ভাসান’ বা ‘ভাসমান’ বলেও ডাকে।

পটুয়াখালীর দুর্গম রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ঘাটে শতাধিক মানতার বাস। জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর চরে থাকেন আরও প্রায় ২০০ মানতা। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলার পদ্মা-মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর পাড়েও থাকেন অনেক মানতা।

কখন, কীভাবে এবং কেন তাদের নাম ‘মানতা’ হলো সেটি ঠিকভাবে বলতে পারেন না এই সম্প্রদায়ের বর্তমান সদস্যরা। বংশপরম্পরায় মানতা নামে পরিচিত হয়ে আসছেন তারা।

চরমোন্তাজ ঘাটে থাকেন ৪৫ বছর বয়সী সনু তালুকদার।

তিনি বলেন, ‘ছোড বেলা থেইকা মা-বাবার লগে নৌকার ডালে ডালে সাঁতরাইছি আর মাছ ধরা শিখছি। মা কইছে এইডাই (নৌকা) তোর সব। তুই এইহানে অইছো আবার এইহানেই মরবি।

‘মোর বয়স যহন ৩৭ বা ৪০ মনে নাই, এইরহমই অইবে, তহন মোর বাবটা (বাবা) মইরা গেছে। মনে আছে, পানপট্টির চরে ছিল মোগো বহর (নৌকার বহর)। তহন ওই চরে বাবডারে দাপন (দাফন) করতে চাইছিলাম। মহিষের লোকজন বাধা দিছে বইল্লা নদীতে ভাসাইয়া দিছি। চোহের সামনে এহনও ভাসে।’

মানতা কথার অর্থ কী এমন প্রশ্নের উত্তরে সনু বলেন, ‘জানি না। হারাদিন মাছ ধরি। যা পাই কিছু বিক্রি করি, আবার কিছু নিজেরা রাহি খাওনের লইগা। রাইতে নাখ ডাইক্কা ঘুম দিই। সবাই কয় মোরা মানতা। মোগো কোনো ঠিহানা নাই। হেই জন্য মনে অয় মোগো মানতা কয়।’

চরমোন্তাজ ঘাটে নৌকা ভেড়ানো ছিল লিপি বেগমের।

তিনি জানালেন, মানতারা সাধারণত নদীভাঙনের শিকার। উপকূলীয় বিভিন্ন নদীর তীরে বাস করা মানুষই একসময় মানতা সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাড়িঘর সব হারিয়ে কোনো উপায় না পেয়ে নদীতে মাছ ধরার কাজে নামেন তারা। আর এভাবেই উপকূলীয় এলাকায় মানতাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

২৫ বছর বয়সী মেঘলা আক্তারের স্বামী নুর জামাল হোসেন নৌকায় মাছ ধরেন। তার বাবা মঞ্জু মিয়ার বিয়ে হয়েছে এই নৌকায়। তার মা মারা গেছেন নৌকাতেই। মারা যাওয়ার পর বাবার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।

মরদেহ সৎকারের এমন রীতির কথা জানালেন অন্য মানতারাও।

চরমোন্তাজ খালগোড়া এলাকার স্থানীয় লোকজন জানান, সাধারণত যেসব নদীর পানিতে জোয়ার-ভাটার টানে খুব ধীরগতি, সেখানেই নোঙর করে মানতাদের বহর। এই বহর দিনের বেলা কিছুক্ষণের জন্য নদীর তীরে থাকলেও রাতে চুরি-ডাকাতির ভয়ে মাঝনদীতেই অবস্থান নেয়।

তারা জানান, খালগোড়ার চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। গত কয়েক বছর ধরে শতাধিক মানতা পরিবার রাতে এখানে বহর নিয়ে থাকে। তাদের দেখভাল করেন স্থানীয় লোকজন।

নৌকায় উঠলেই বিয়ে

চরমোন্তাজের খালগোড়ায় নৌকার বহরে থাকেন সালাম মিয়া।

তিনি জানান, চাঁদনি বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে নৌকায়। বিয়েতে তাকে একটি নৌকা দেয়া হয়েছিল। সেটি এখনও আছে।

বিয়ে কীভাবে হয় জানতে চাইলে সালাম মিয়া বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে পছন্দ করলে মেয়ের নৌকায় গিয়ে ওঠে। তারপর তাদের নিজস্ব কায়দায় বিয়ে হয়। সেখানে কোনো কাবিন বা রেজিস্ট্রি করার পদ্ধতি নাই।’

তিনি বলেন, ‘তারপর ওই ছেলে-মেয়ে নৌকায়ই জীবন যাপন করেন। আবার যদি কোনো কারণে তাদের বিচ্ছেদ বা বিয়ে ভেঙে যায়, তাহলে ওই নৌকা মেয়েকে দিতে হয়। মেয়েকে নৌকা দিয়ে দিলেই তাদের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।’

সালাম মিয়া বলেন, ‘পুনরায় ওই মেয়েকে যদি কেউ বিয়ে করতে চায়, তাহলে সেই ছেলে যদি ওই মেয়ের নৌকায় উঠে তাহলেই তাদের মধ্যে আবার বিয়ে হয়ে যায়।’

সালামের স্ত্রী চাঁদনি জানান, তাদের মধ্যে বিয়ে করার এই পদ্ধতি এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে।

এবার ডাঙায় থাকার সুযোগ

সামাজিকভাবে পরিচিত করার জন্য এবার মানতা সম্প্রদায়ের সদস্যদের ডাঙায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে চরমোন্তাজে তাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ২৯টি পাকা ঘর।

এই খবরে মানতাদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন দারুণ খুশি। ঘরে বসবাসের সুযোগের পাশাপাশি স্থায়ী ঠিকানা পাবে এদের পরের প্রজন্ম।

চরমোন্তাজে মানতাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এই পাকা ঘরগুলো

মানতাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। ফলে সরকার ঘোষিত বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা ও বয়স্ক ভাতা এমনকি মাতৃত্বকালীন শিশুপুষ্টি ভাতার তালিকায়ও এদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে।

এ বিষয়ে চরমোন্তাজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হানিফ বলেন, ‘লঞ্চঘাটসংলগ্ন সরকারি খাসজমিতে এসব ঘর নির্মাণ এখন প্রায় শেষ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করবে এই জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো মানতা সম্প্রদায়ের জন্য সরকার ঘর নির্মাণ করছে। সেটিও আমার এলাকায় হওয়ায় আমি গর্বিত।’

তিনি বলেন, ‘আমি ছোডব্যালা থেকে এই মানতাগো দেইখা আইছি। প্রথমবার চেয়ারম্যান অইয়া এগো জন্য যতটুকু পারছি সাহায্য-সহযোগিতা করছি। ভোটার তালিকায় তাদের নাম না থাকায় স্থায়ী কিছু করতে পারি নাই। এহন সুযোগ আইছে ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবে না।’

এই প্রথম মানতাদের জন্য ঘর নির্মাণ করেছে সরকার

চরমোন্তাজের স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক এম আজাদ খান সাথী বলেন, ‘দিন-রাইত চব্বিশ ঘণ্টাই এরা নদীতে ভাসতে থাকায়, এদের পরের প্রজন্মের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। কারণ এরা সকালে ছিল নদীর এপাড়ে আবার দুপুরে অন্য পাড়ে। বিকেলে নদীর এক প্রান্তে, রাতে অন্য প্রান্তে। কোনো জায়গায় স্থায়ী না হওয়ায় তাদের শিশুদের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তি করিয়ে পড়াশোনা করানো সম্ভব ছিল না।

তিনি জানান, এরই মধ্যে এই সম্প্রদায়ের ঝরে পড়া শিশুদের জন্য বেসরকারিভাবে একটি বোর্ডিং স্কুল চালু হয়েছে। এর নাম রাখা হয়েছে শিশুবাগান। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষা নিতে শুরু করছে মানতা সম্প্রদায়ের শিশুরা।

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মানতা সম্প্রদায়। তবে বরিশাল বিভাগে এদের বিচরণটা বেশি। এদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা অর্থাৎ ঠিকানাবিহীন থাকায় এত দিন পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।’

তিনি বলেন, ‘এ কারণে সরকারও এদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেনি। তবে প্রায় ৩০ বছর পর এ বছরের জানুয়ারিতে এদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

‘তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে এদের জন্য সরকারি খাসজমি নির্ধারণের পর সেখানে ঘর নির্মাণ শুরু হয়। আজ যা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।’

মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘চরমোন্তাজের এই ২৯টি ঘরের মাধ্যমে এদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। এরপর সারা দেশেই মানতাদের পুনর্বাসন করা হবে। এতে খুব সহজেই সরকারি বিভিন্ন খাদ্য সহায়তার আওতায় আসতে পারবে তারা।’

এ বিভাগের আরো খবর