বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রংপুরে নারী শ্রমজীবী বেশি কেন

  •    
  • ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৯:০৫

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘এই অঞ্চল মূলত দারিদ্র্যপীড়িত। দরিদ্র্রের হার বেশি। একটি সংসারে যে পরিমাণ ব্যয়, তা একজন পুরুষের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। তাই স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও কাজে অংশ নিচ্ছেন বা করছেন।’

মধ্যবয়সী নারী বিথী বেগম। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর বাড়াইপাড়া গ্রামে বাড়ি তার। স্বামী মন্তাজুর রহমান আর দুই মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার।

টানাপোড়েনের সংসারে চার বছর আগে স্বামী-স্ত্রী মিলে রংপুরের স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। খেয়েপরে বড় মেয়ে তানজিলাকে বিয়ে দিয়েছেন গত বছর।

বাড়তি টাকা দিয়ে বন্ধক নিয়েছেন দুই ‘দোন’ জমি। ছোট মেয়ে তাসলিমাকে পড়ান স্থানীয় একটি স্কুলে। এখন আর আগের অভাব নেই তাদের ঘরে।

বিথীর ছোট বোন সুমি বেগম। তিনিও কাজ করেন মিঠাপুকুরের একটি পোশাক কারখানায়। প্রোডাকশন শাখায় কাজ করে তার মাসে সর্বনিম্ন আয় ১০ হাজার টাকা।

স্বামীর সংসারে না থাকলেও নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আর সংসার দিব্যি চলছে সুমির। তিনি কিনেছেন আট শতক জমি। বাড়ি বানিয়ে বসবাসও করছেন সেখানে।

রংপুরের কর্মজীবী অন্তত ২০ নারীর সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তাদের সবার প্রায় একই কথা। সংসারের অভাব-অনটন ঘোচানোর পাশাপাশি সচ্ছলতা ফেরাতে কাজ করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে প্রতিটি ঘরে রয়েছেন শ্রমজীবী নারী। এই অঞ্চলে এখন ধীরে ধীরে কর্মজীবনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। শহরের তুলনায় গ্রামে বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণও বাড়ছে।

রংপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও উন্নয়নকর্মী রফিক সরকার বলেন, ‘এক যুগ আগেও এমন দৃশ্য গ্রামে ছিল না যে, দলবেঁধে নারীরা কর্মস্থলে যেতেন বা মাঠে কাজ করতেন। সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। চাকরি, কৃষি আর ব্যবসায় পুরোপুরি কাজ করছেন তারা।

‘ফলে এই নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। এ কারণে তাদের সমাজে ও পরিবারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।’

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে এক গবেষণায় বলেছে, রংপুর বিভাগে নারী শ্রমিকের শতকরা হার ৩৮, যা দেশে সবচেয়ে বেশি।

রংপুর উইমেন্স চেম্বারের প্রেসিডেন্ট আনোয়ারা ফেরদৌসী পলি বলেন, ‘শুধু রংপুরেই ৫ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারী ব্যবসায়ী রয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। স্বল্প পুঁজি নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন। পুরুষশাসিত সমাজে তারা কর্মক্ষেত্রে টিকে আছেন।

‘মাঠেঘাটে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক। নারীর অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাই কোনো নারী যেন বেকার না থাকেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসবেন।’

রংপুর কারুপণ্য লিমিটেডের জনসংযোগ পরামশর্ক মাহবুব রহমান হাবু জানান, রংপুরে তাদের কারখানায় ৪ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করেন, যাদের সবার বাড়ি রংপুরে।

তিনি বলেন, ‘নারী শ্রমিকরা নিজের বাড়িতে থেকে কারখানায় এসে কাজ করতে পারছেন। তাতে অনেকেই কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করছেন। যারা ঢাকায় থাকেন, তারা বাসা ভাড়া দিয়ে এই টাকা উপার্জন করছেন। তাই বাড়িতে থেকেই অনেক নারী শ্রমিক এখন কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’

নারী শ্রমজীবী বেশি কেন

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু মনে করেন, শুধু পেটের দায়ে নারীরা ঘর থেকে বের হননি বা হচ্ছেন না; বরং কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘নারীরা ঘরে থাকতে চান না, কাজ করতে চান। তারা স্বনির্ভর হতে চান। এই অঞ্চলে গ্রামের কৃষিতে পুরুষের কাজ কমে আসছে। ফলে পুরুষের জায়গা নারীরা দখল করছেন।

‘আর নারীর প্রতি মানুষের বিশ্বাস আছে। অনিয়ম-দুর্নীতি করেন না। যতক্ষণ কাজ করেন, ততক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন। ফলে নারী শ্রমিক বাড়ছে।’

বাড়ছে না নারীর প্রত্যাশিত উন্নয়ন

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘এই অঞ্চল মূলত দারিদ্র্যপীড়িত। দরিদ্রের হার বেশি। একটি সংসারে যে পরিমাণ ব্যয়, তা একজন পুরুষের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। তাই স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও কাজে অংশ নিচ্ছেন বা করছেন।

‘এ ছাড়া রংপুর অঞ্চলে একসময় নানা বাধার কারণে নারীরা মাঠে কাজে যেতেন না। এখন সেই বাধা নেই। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে সামাজিক বাধাটা এখন কম। সামাজিকভাবে বাধাহীনভাবে নারীরা কাজ করতে পারছেন।’

ড. মোরশেদ মনে করেন, সামগ্রিকভাবে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় এ অঞ্চলে বেড়েছে। বিশেষ করে গ্রামের নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়ে গেছে। আগে যে কাজ পুরুষ করতেন, এখন সেই কাজ নারীরাও করছেন সমানভাবে। কিন্তু নারীদের প্রত্যাশিত উন্নয়ন হচ্ছে না।

অংশগ্রহণ বেড়েছে, পরিবর্তন আসেনি

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মারুফা রহমান মনে করেন, শহর থেকে এখন গ্রামেও বদলে গেছে চিত্র। গ্রামীণ নারীরাও বাইরে পুরোদমে কাজ করছেন। কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে তাদের। এটা আশাব্যঞ্জক। তবে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে তাদের গুণগত পরিবর্তন এবং পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। আগের তুলনায় বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ বাড়ছেই। পরিবর্তনের পথে আমরা হাঁটা শুরু করেছি।

‘তবে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান উন্নয়নের যে জায়গা, সেটা এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। এখনও অনেক বাধা রয়েছে। সেটা দূর করতে পারলে আমরা যে নারী সমতার কথা বলি সেটা অর্জন হবে।’

খুশি নারী নেত্রীরা

রংপুর মহিলা পরিষদের সভাপতি হাসনা চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই একটা ভালো খবর যে, আমাদের মেয়েরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। এটা আমাদের গর্বের বিষয়। মেয়েরা ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কর্মজীবন বেছে নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের চিন্তা-চেতনার যে বিকাশ, তার অভাব রয়েছে। তারা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।

‘আমি মনে করি, কাজের ক্ষেত্রে নারীর মান বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা দিতে হবে। কর্মপরিবেশের অভাবেই পিছিয়ে নারীরা। সেই সঙ্গে যারা উদ্যোক্তা, তাদের বিনা পুঁজিতে ঋণ দিতে হবে। আমরা চাই নারীরা সচেতনভাবে আরও বেরিয়ে আসুক। দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখুক।’

রংপুর পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপপরিচালক আরিফুল ইসলাম জানান, রংপুর অঞ্চলের নারী শ্রমজীবীর সংখ্যা কত এ নিয়ে কখনো গবেষণা হয়নি।

এ বিভাগের আরো খবর