বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জীবন সংগ্রামে দাউদকান্দির অর্ধশতাধিক প্রান্তিক মুচিরা

  • দাউদকান্দি (কুমিল্লা) প্রতিনিধি   
  • ১১ অক্টোবর, ২০২৫ ১৮:১৪

কুমিল্লার দাউদকান্দি পৌর এলাকার ব্যস্ত বাজারের এক কোণে বসে আছে কয়েক প্রজন্মের শ্রমের গল্প। এই বাজারে এখনো টিকে আছেন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন পাদুকা মেরামত কারিগর। যাদের জীবন চলছে এক অনিশ্চিত ছন্দে। সমাজের প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীকে কেউ বিশেষভাবে মনে রাখে না। তাদের খোঁজ নেয় না কোনো সংস্থা বা সরকারি দপ্তর। তবুও তারা কাজ থামাননি। কারণ, জীবন থামেনি তাদের জন্য।প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ পায়ের জুতা সেলাই করেন, কেউ পুরনো স্যান্ডেল নতুন করে জোড়া লাগান। একসময় দাউদকান্দির প্রায় প্রতিটি বাজারেই মুচিদের দেখা মিলত, এখন সেই সংখ্যা দ্রুত কমে এসেছে।বংশপরম্পরায় পাওয়া এই পেশা এখন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আধুনিক জুতার দোকানের জন্য কারিগরদের চাহিদা যেমন কমছে, তেমনি আয়ও ক্রমেই সীমিত হয়ে পড়ছে।তাদের জীবনযাপন প্রায় সব দিক থেকেই বঞ্চনার প্রতীক। শিক্ষার আলো তেমনভাবে ছুঁতে পারেনি এই সম্প্রদায়কে। সন্তানদের বেশিরভাগই অন্য পেশায় যেতে চায়, কারণ তারা জানে পাদুকা মেরামতের কাজে টিকে থাকা মানে অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুদ্ধ করা। তবুও কারিগরদের কেউ কেউ এখনো এই পুরনো পেশাকেই আঁকড়ে আছেন। কারণ এটিই তাদের পরিচয়। এটিই তাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন।বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই জুতা মেরামত করেন স্বপন সাহা। তিনি বলেন আমরা জীবিকার সাথে সংগ্রাম করেই কোনমতে টিকে আছি। আমাদের সরকারী সহায়তা নেই। ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই। যেদিন কাজ করি সেদিন খাবার জুটে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেখানে জীবন চলে কোনোরকমে সেখানে সন্তানদের পড়াশোনা আমাদের জন্য এক রকম বিলাসিতা।পরিমল নামে আরেক পাদুকা মেরামতকারী বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে আমরা এ পেশায় জড়িত। অন্য কোনো কাজ শেখা হয়নি। আগের মত নেই ব্যবসা। সম্মান না থাকায় এবং আয় কমে যাওয়ায় সন্তানরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী নয়।বহু বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ করেছেন তারা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে স্থানীয় পৌর প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে তাদের কর্মস্থলে নির্মিত হয়েছে ছাউনি। ছোট এই উদ্যোগ তাদের জীবনে এনে দিয়েছে বড় স্বস্তি। ঝড়বৃষ্টি এলে এখন আর কাজ বন্ধ রাখতে হয় না, মাথার উপর আছে একটি নিরাপদ আশ্রয়।পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিল্লাল হোসেন সুমন বলেন, তারা আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দীর্ঘদিন পর তাদের মাথার উপর ছাউনি নির্মাণ করে দিতে পেরে নিজের দায় কিছুটা পরিশোধ করেছি। শিক্ষাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাদের সমাজের মূল স্রোত ধারায় যুক্ত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।কিন্তু সমস্যার শেষ এখানেই নয়। জীবিকা অনিশ্চিত, আয় সামান্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ সীমিত। সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা তাদের জীবনে তেমনভাবে পৌঁছায়নি। বাজারে বসে তারা প্রতিদিন মানুষের ভাঙা জুতা মেরামত করেন, কিন্তু নিজেদের ভাঙা জীবনের জোড়া মেলানোর কোনো উপায় খুঁজে পান না।দাউদকান্দির স্থানীয়রা মনে করেন, এই পেশাটি শুধু জীবিকা নয়—এটি ঐতিহ্যের অংশ। মুচিরা সমাজের নীরব কর্মযোদ্ধা, যারা বিনিময়ে খুব বেশি কিছু আশা করেন না। অথচ তাদের উপস্থিতি ছাড়া সমাজের একটি মৌলিক চাহিদাই অপূর্ণ থেকে যায়।দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই স্থানে বসে কাজ করছেন এই মুচি সম্প্রদায়ের সদস্যরা। সরকারি নজরদারির অভাবে তারা ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছেন। তবুও নিরবে, নিয়মিতভাবে তারা মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের হাতের ছোঁয়ায় পুরনো জুতা নতুন রূপ পায়, কিন্তু তাদের নিজের জীবনে আসে না নতুন কোনো ভোর।তাদের গল্প আসলে টিকে থাকার গল্প—অভিযোগহীন, অনুযোগহীন এক শ্রেণির মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস। তারা সমাজের অবহেলিত প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন প্রমাণ করে চলেছেন, সামান্য আয়, ভাঙা যন্ত্রপাতি আর জীর্ণ ঘর নিয়েও বেঁচে থাকা যায় সম্মানের সঙ্গে, যদি থাকে পরিশ্রম ও স্থিতির বিশ্বাস।

এ বিভাগের আরো খবর