দুটি ছোট কক্ষ, সামনে খোলা বারান্দা, মাথার ওপরে টিনের ছাউনি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। এ যেন রোগীদের জন্য নয়, দুর্ভোগেরই আরেক নাম- কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল।
এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে মাত্র দুটি কক্ষে বসেন মেডিসিন বিভাগের ৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। একজন চিকিৎসক প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ জন রোগী দেখেন। কিন্তু চিকিৎসকের বসার জায়গা পর্যন্ত নেই, রোগীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত চেয়ার বা পর্যবেক্ষণ বেড। এত রোগীর চাপ থাকলেও লোকবল সংকট ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে রোগী ও তাদের স্বজনদের যেমন সমস্যা হয়, তেমনি চিকিৎসায় মনোযোগ দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগের শেষ নেই।
জানা গেছে, কুমিল্লা জেনালে হাসপাতালটি দেড়শ বছরের পুরোনো হলেও বাড়েনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। তথ্য মোতাবেক ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কুমিল্লা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি বাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ১৮৭১ সালের দিকে কুমিল্লা দাতব্য চিকিৎসালয়ের নামে প্রতিষ্ঠানটিতে রোগী ভর্তি শুরু করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠানটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পরিণত হয়। যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল বা সদর হাসপাতাল নামে পরিচিত। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রোগী দেখেন চিকিৎসকরা। মাত্র ৫০ শয্যার হলেও জেলার অন্যতম সরকারি হাসপাতালটির বহির্বিভাগে বছরে চিকিৎসা নেন কয়েক লাখ মানুষ। তবে পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় দিন দিন সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অবকাঠামগত সংকটে শয্যা না থাকায় একটি কক্ষে যেমন চারটি বিভাগের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে, তেমনি দিন দিন অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁতিপূর্ণ হয়ে পড়ছে হাসপাতালের ভবনগুলো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগের সামনে সহস্রাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন টিকিটের জন্য। কেউ কেউ পাশের গাছের নিচে বসে অপেক্ষা করছিলেন কখন তার ডাক আসবে টিকিটের জন্য।
পায়ের গোড়ালি সমস্যা নিয়ে আসমা বেগম (৬০) জানালেন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা-ব্যথা হয়ে গেছে। তাই তার মেয়েকে সিরিয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিনি পাশের গাছ তলায় অপেক্ষা করছেন। এদিকে বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করা রাজন আহমেদ এক দিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন অফিস থেকে। তার স্ত্রীর থাইরয়েড সমস্যা। তিনি স্ত্রীর জন্য টিকিট নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। আক্ষেপ করে রাজন বলেন, ‘টিকিট কাটতেই আধা ঘণ্টা সময় লাগছে। ডাক্তার দেখিয়ে আবার শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বাড়ি কখন যাব।’
নাম না প্রকাশ করার শর্তে আবাসিক ও বহির্বিভাগের অন্তত ৩ জন চিকিৎসক জানান, এত রোগীর চাপ, অথচ সে অনুযায়ী লোকবল নেই। প্রতিনিদই দেড় হাজার থেকে দুই হাজার রোগী দেখতে হয়। অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। সব মিলিয়ে চিকিৎসার মতো এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে এই পরিবেশে মনোযোগ ধরে রেখে চিকিৎসা দেওয়া খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুল করিম খন্দকার জানান, হাসপাতালটিতে দিনের পর দিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে লোকবলের সমস্যাও।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন মন্ত্রণালয়ে আড়াইশ বেড হাসপাতালে উন্নতি করার জন্য আবেদন করা হয়েছে।
কুমিল্লাসহ আশেপাশের জেলার মানুষজনও জেনারেল হাসপাতালে আসেন সেবা নিতে। এখানে মেডিসিন, সার্জারি, শিশু ও গাইনি, অর্থোপেডিকসহ মোট নয়টি ইউনিটে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে। আই সি ইউসহ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা দিচ্ছেন শতাধিক চিকিৎসক ও নার্স। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি হাসপাতালটিকে আড়াইশ শয্যায় উন্নীতকরণের জন্য আবেদন করা হয়েছে মন্ত্রণালয়। যত দ্রুত এই প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন হবে কুমিল্লাসহ আশেপাশের জেলার মানুষজন তত ভালো সেবা পাবেন।