একসময় নওগাঁ শহরের অলিগলিতে প্রতিদিন ভেসে আসত প্যাডেল চালিত রিকশার পরিচিত ‘ক্রিং ক্রিং’ আর ‘টুং টাং’ বেলের শব্দ। সেই রিকশার চাকা ঘুরে চলত শত শত পরিবারের জীবনযাপন। কিন্তু সময়ের পালাবদলে সেই ঐতিহ্য প্রায় বিলুপ্তির পথে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও লাভজনক আয়ের আশায় শহরের প্রায় সব রিকশাচালকই এখন ঝুঁকছেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দিকে।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার প্রতি ঝুঁকছে চালকরা:
প্যাডেল রিকশায় পরিশ্রম বেশি হলেও আয় কম। পক্ষান্তরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে কম শ্রমে বেশি আয়ের সুযোগ থাকায় অনেকেই বদলে ফেলেছেন পেশার ধরন। ফলে শহর ও গ্রামাঞ্চলে অটোরিকশার সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
প্যাডেল রিকশার চালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ এখন আর প্যাডেলের রিকশায় উঠতে চায় না। তাই বেশির ভাগ সময় অলস বসে থাকতে হয়। আগে দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হতো, এখন সেটা ৮০-১০০ টাকায় নেমে এসেছে। এত অল্প আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক মিঠু হোসেন জানান, রিকশায় খাটুনি বেশি, অথচ আয় কম। অটোরিকশা চালিয়ে দিনে ৫০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। কিস্তিতে কেনা যায় বলেও অনেকের পক্ষে এটি সহজলভ্য।
উৎপাদন বাড়ছে, ব্যয়ও বাড়ছে:
নওগাঁয় বর্তমানে প্রায় ৫০টি কারখানায় প্রতি মাসে গড়ে ২৫০টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তৈরি হচ্ছে। তবে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে অনেক গুণ। রড ও শিটের দাম বিগত দুই বছরে বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ।
শরিফুল ইসলাম নামের একজন কারখানা মালিক জানান, একটি অটোরিকশার ফ্রেম বা বডি তৈরিতে খরচ পড়ে অন্তত ৮০ হাজার টাকা। ব্যাটারিসহ পুরো অটোরিকশার খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অনেক সময় এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে হয়, কারণ ব্যাংক ঋণ পেতে হলে জমি বা ঘরের কাগজ লাগে, যা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।
কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত:
নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরীর উপব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চাহিদা বাড়ায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারখানার সংখ্যাও বেড়েছে। শিল্প সম্ভাবনা আরও বাড়াতে কারিগরি প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে বিসিক।’
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য:
যেখানে এক সময় অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে একমাত্র ভরসা ছিল প্যাডেল চালিত রিকশা, সেখানে এখন তা অতীত হতে চলেছে। শহরে বর্তমানে হাতে গোনা মাত্র ৩টি প্যাডেল রিকশা দেখা যায়, যার চালকরাও অধিকাংশই বয়সে প্রবীণ। একসময় যে রিকশাগুলোর নির্মাণে ব্যস্ত ছিল ৫০টিরও বেশি কারখানা, যার মাসিক উৎপাদন ব্যয় প্রায় ২ কোটি টাকা। এখন সেগুলোও ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে স্মৃতিতে।
এক সময়ের অপরিহার্য বাহন হয়তো আগামী প্রজন্মের কাছে রয়ে যাবে কেবল ইতিহাসের পাতায় কিংবা জাদুঘরের প্রদর্শনীতে।