বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দেশে সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের আত্মহননের ঘটনা বাড়ছে

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ২৪ আগস্ট, ২০২৫ ১২:০০

গত এক যুগে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আত্মহননের ঘটনা বাড়ছে। আর্থিক অনিশ্চয়তা, পেশাগত চাপ ও পারিবারিক সংকট এগুলোর পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সম্প্রতি ‘আজকের পত্রিকা’র প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুও এ তালিকায় যোগ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হতাশাজনিত বিষণ্নতা থেকেই এসব ঘটনা ঘটছে এবং সাংবাদিক কল্যাণে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।

৭১ বছর বয়সি বিভুরঞ্জন চাকরি করতেন ‘আজকের পত্রিকা’য়। এর বাইরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লিখতেন। অফিসে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে এক দিন আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি।

নিখোঁজ হওয়ার আগে ২১ আগস্ট সকাল ৯টায় তিনি অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একটি খোলা চিঠি মেইল করেন।

চিঠির ফুটনোটে তিনি লেখেন, ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।’ বিভুরঞ্জন সরকারের পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা যায়, ওই দিন সকাল ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি আর ফেরেননি।

খোলা চিঠিতে বিভুরঞ্জন সরকার নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিকেল পাস সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় ‘ফেল করা’, বুয়েট থেকে পাস করা ছেলের ‘চাকরি না হওয়া’ এবং নিজের বেতন-ভাতা না বাড়ার ফলে আর্থিক দৈন্য নিয়ে হতাশার কথা লিখেছেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হয়তো এসব কারণেই আত্মহত্যা করেছেন।

তবে গত এক যুগে সাংবাদিকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এ সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যম ঘেঁটে যতজন সাংবাদিকের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে, এদের বেশির ভাগই নিজেদের অপমৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন প্রধানত পেশাগত ও আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং পারিবারিক সংকটের কারণে। সাংবাদিকের পাশাপাশি এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ বুদ্ধিজীবী পরিবারের বেশ কিছু সদস্যের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

২০১২ সালের মার্চ মাসে বিখ্যাত সাংবাদিক মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। আশির দশকের আলোচিত সাময়িকী ‘বিচিন্তা’র সম্পাদক ছিলেন মিনার মাহমুদ।

ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সপ্তম তলার একটি কক্ষ থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সে সময় ওই কক্ষে প্রায় ১০০টি ঘুমের বড়ির খোসা পেয়েছিল পুলিশ।

হোটেলকক্ষ থেকে মিনার মাহমুদের লাশের সঙ্গে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি চিঠিও পাওয়া গিয়েছিল, যা তিনি লিখেছেন স্ত্রী লাজুককে উদ্দেশ করে। লাজুকের সঙ্গে বিয়ের আগে তার দাম্পত্য কাটে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। মিনারের চিঠিতে জাগতিক অসফলতা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল গভীর এক হতাশা।

আলোচিত আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন জাহিদের। ২০১৮ সালের আগস্টে রেললাইনের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন সুমন জাহিদ।

সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা কবিরের আত্মহত্যার ঘটনাটিও দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। ২০২৩ সালের জুন মাসে আত্মহত্যা করেন অর্পিতা কবির। আত্মহত্যার আগে সুইসাইড নোট হিসেবে একটি চিরকুট লিখে যান তিনি। ধারণা করা হয়, পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেন অর্পিতা।

শাহরিয়ার কবিরের পরিবারে আগেও একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৬ সালে তার ভাই কালানদিয়ার কবির আত্মহত্যা করেন। পারিবারিক ও বৈষয়িক সম্পত্তিসংক্রান্ত জটিলতা এবং সংকটের মধ্যে পড়ে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে সে সময় অভিযোগ উঠেছিল।

আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল ফটোসাংবাদিক শবনম শারমিনের (৩০) আত্মহত্যা। স্বজনদের অভিযোগ, স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। অবশ্য আত্মহত্যার পর কর্মক্ষেত্রে তার নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগও উঠেছিল।

২০২২ সালের ১৩ জুলাই উদ্ধার করা হয় সাংবাদিক সোহানা তুলির (৩৮) লাশ। পুলিশের ধারণা, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি কালেরকণ্ঠ, বাংলা ট্রিবিউন ও আমাদের সময় পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। পারিবারিক কলহের জেরে তুলি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে সে সময় কথা উঠেছিল।

আর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট হাতিরঝিল থেকে গাজী টিভির নিউজরুম এডিটর রাহনুমা সারাহর (৩২) লাশ উদ্ধার হয়। সে সময় রাহনুমার স্বামীর দাবি করেছিলেন, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে ফেসবুকে রাহনুমার শেষ পোস্ট ছিল, ‘মরে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভালো’। নিজের কর্মস্থল নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন রাহনুমা। মৃত্যুর আগে তিন মাস ধরে তিনি বেতন পাননি বলে তখন অভিযোগ উঠেছিল।

দেখা গেছে, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী পরিবারের এসব আত্মহত্যার পেছনে প্রধানত কাজ করেছে হতাশাজনিত বিষণ্নতা। পেশাগত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি পারিবারিক সংকট এর নেপথ্যে দায়ী বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমেদ হেলাল।

বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যসহ সাংবাদিকদের মধ্যে কেন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে—প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মানুষ মূলত আত্মহত্যা করে হতাশাজনিত বিষণ্নতা থেকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাশের দেশ ভারতেও আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমাদের এখানে সাংবাদিকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে কি না, গবেষণা না করে তা বলা যাবে না। তবে এই সময়ের মধ্যে যেসব সাংবাদিক আত্মহত্যা করেছেন, তাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগই হতাশ হয়ে বিষণ্নতায় ভুগে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে অনেকেরই হয়তো পেশাগত ও আর্থিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি পারিবারিক সংকটও একটি কারণ। কেনো মানুষ আসলে নির্দিষ্ট একটিমাত্র কারণে আত্মহত্যা করেন না, এর পেছনে বহুমাত্রিক কারণ থাকে।’

তবে আত্মহত্যা কোনোভাবেই সমাধান নয় উল্লেখ করে আহমেদ হেলাল বলেন, ‘হতাশা যখন বিষণ্নতায় রূপ নেয়, তখনই মানুষ আত্মহত্যা করে। আর যিনি আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে সবকিছু শেষ হয়ে গেল বলে ভাবেন, তিনি আসলে নিজের পরিবারকে নতুন ঝুঁকিতে ফেলে দেন। তাই আমাদের আশপাশে যেসব মানুষ আছেন, তারা হতাশ ও বিষণ্ন কি না, সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার।’

এদিকে সাংবাদিকদের এমন আত্মহত্যার পেছনে রাষ্ট্রেরও দায় আছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন, তারা অনেক স্বপ্ন আর সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য এখানে আসেন। কিন্তু একসময় যদি কোনো সংবাদিকের মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক, পারিপার্শ্বিকভাবে তিনি যথেষ্ট স্বাচ্ছনন্দ্যে নেই, তখন তার পরিবারেও এর ছাপ পড়তে বাধ্য। এ সময় হতাশা ও বিষণ্নতা স্বাভাবিকভাবেই তাকে গ্রাস করতে পারে। আসলে সাংবাদিকদের কল্যাণে রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা দরকার। এক্ষেত্রে সাংবাদিকতা পেশাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ব্যাপারে রাষ্ট্রের যেমন ভূমিকা রয়েছে, একইভাবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সংবাদকর্মীরা যাতে ওয়েজ বোর্ডে তাদের প্রাপ্য বেতন পান, তা নিশ্চিত করার বিষয়েও রাষ্ট্র ভূমিকা রাখতে পারে।’

সূত্র: কালেরকণ্ঠ

এ বিভাগের আরো খবর