নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার মসরইল গ্রামের এক মেধাবী শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যার ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো উদঘাটন হয়নি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য। তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় হতাশ ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে নিহতের পরিবার। বিচারের আশায় দিন গুনছে তারা। স্থানীয়দের মধ্যেও বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। তারা দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয় মধইল বিএল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় গণিত বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। তার ঘরে এখন ঝুলছে আইডি কার্ড, ফাঁকা পড়ে আছে শোবার ঘর। বিলাপ করছেন পরিবারের সদস্যরা। মাঝে মাঝেই মোস্তাফিজুর রহমান এর ঘরে গিয়ে ছবি আঁকড়ে ধরে কাঁন্না করেন তার মা। এক অজানা কারনে ঝড়ে গেল তাজা প্রাণ।
যেভাবে পাওয়া যায় মোস্তাফিজুরের লাশ:
গত বছরের ৬নভেম্বর সন্ধ্যার সময় মোস্তাফিজুর রহমান মাগরিবের নামাজ পড়তে গ্রামের একটি মসজিদে যায়। নামাজ পড়ে সে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। দীর্ঘ সময় পরেও বাড়িতে না আসায় তার পরিবারের লোকজন মসজিদে খোঁজ নেন। সেখানে গিয়ে তাকে না পেয়ে সকল আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও খোঁজ খবর নেওয়া হয়। তারপরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজের আটদিন পর ১৩নভেম্বর দুপুরে স্থানীয়রা মাঠের মধ্যে কয়েকটি হাড় ও নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে থাকতে দেখে। এরপর তারা সেখানে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ধানক্ষেতের ভেতরে একটি গর্ত দেখতে পায়। সেখানের মাটি সরিয়ে দেখে একটি অর্ধগলিত মরদেহ পড়ে আছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তার শার্ট ও লুঙ্গি দেখে মোস্তাফিজুরের লাশ শনাক্ত করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। ঘটনার পর মামলা হলেও এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
দিশেহারা মোস্তাফিজুরের পরিবার:
বিলাপ করে মোস্তাফিজুর রহমানের মা মোসলেমা আক্তার বলেন, ঘটনার দিন মাগরিবের নামাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আমার কলিজার টকরো সন্তানটি আর ফিরেনি। তারপর রাত গড়িয়ে যায় তবুও খোঁজ পাইনা। গ্রামের অনেকের বাড়ি ও পরিচতজনদের সাথে যোগাযোগ করে কোন সন্ধান পাইনি। তার ৮দিন পর ধানক্ষেতে টুকরো-টুকরো হাড়সহ অর্ধগলিত দেহ পাওয়া যায়। গায়ের কাপড় ও দেহেরে কিছু অংশ দেখে শনাক্ত করি যে ওটা আমার মোস্তাফিজুর। পুলিশ ডিএনএ টেস্ট করেও নিশ্চিত হয় যে ওটা আমার সন্তান। প্রায় ১০মাস হয়ে যাচ্ছে তবুও আমার সন্তানের হত্যার বিচার পাইনি। কারা মারলো, কি কারনে মারলো এসবের উত্তর আজও অজানা। আর কিছু বলতে পারছিনা বাবা এই বলেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন।
মোস্তাফিজুরের বাবা আনোয়ার হোসেন ও বোন জিন্নাতুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে মোস্তাফিজুরকে। ১০ মাস কেটে গেলেও আমরা এখনো জানতে পারিনি কে বা কারা এই জঘন্য কাজ করেছে। বিচার তো দূরের কথা, তদন্তেই কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছিনা। একজনকে আটক করা হয়েছিল, সে বর্তমানে জামিনে মুক্ত রয়েছে। কারন সুনিনির্দিষ্ট প্রমাণ নাকি পাওয়া যায়নি তার বিরুদ্ধে। তাই আরও তদন্ত চলছে। সন্দেহভাজন হিসেবে আমরা মামলায় এজাহারে কিছু নাম যুক্ত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পুলিশ তা গ্রহণ করেননি। তারা মাঝে মাঝে আসে আবার চলে যায়। কি তদন্ত হচ্ছে সঠিক না কি সেটা আমরা বুঝতে পারছিনা। এতদিন হয়ে গেল আসামীদের আটক করা হয়নি। এভাবে আর আমরা কত ধৈর্য্য ধরে থাকবো। যার আপনজন হারায় সেই বুঝে কতটা ব্যাথা আর যন্ত্রনা হয়। দ্রুত সঠিক বিচার চাই আমরা। এভাবে যেন আর কোন সন্তানকে খুন হতে না হয়।
স্থানীয়রা যা বলছেন:
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আবুল হোসেন, মসজিদের মোয়াজ্জিন আবুল কালাম আজাদ ও ইউপি সদস্য মনছুর আলীসহ বেশ কয়েকজন বলেন, নিহত মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন শান্ত-শিষ্ট ও ভালো ছেলে। তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন এবং সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। মোস্তাফিজুর কারও সঙ্গে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করেননি। এত নির্মমভাবে হত্যা করার বিষয়টি কেউ মেনে নিতে পারছিনা আমরা। “এভাবে একজন শিক্ষার্থী হত্যার শিকার হবে আর তার বিচার হবে না এটা তারা মেনে নিতে পারছেননা। প্রশাসনের কাছে দাবি দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। সেই সাথে এমন শাস্তি দেয়া হোক যাতে এমন নেক্কারজনক কাজ যেন কেউ করতে সাহস না পায়।
প্রশাসন যা বলছেন:
নওগাঁর পুলিশ সুপার মাহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার বিপিএম জানান, ১৩নভেম্বর স্থানীয়রা মাঠের মধ্যে একটি মৃত দেহ পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত না হওয়ার কারনে ডিএনএ পরিক্ষার মাধ্যমে জানতে পারি মৃতদেহটি মোস্তাফিজুর রহমানের। তদন্ত কার্যক্রম আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তদন্তে প্রমান পাওয়া যায়নি তার বিরুদ্ধে। তবে বাদী পক্ষের একটি অভিযোগ আছে যে, তারা আরও কয়েকজনের নাম তারা বলতে চাচ্ছেন। আমাদের তদন্ত কার্যক্রমে অন্যকারো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাচ্ছিনা। যখনই সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাবো তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলার এই পুলিশ প্রধান আরও বলেন, আমরা চাইনা কোন নিরপরাধ কেউ সাঁজাপ্রাপ্ত হোক। আমরা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে দোষীদের আইন এর আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। পুলিশ স্লো কাজ করছেনা। আমরা ফরেনসিক রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করছি। তদন্তে আমরা মোটামুটি একটা পর্যায়ে চলে এসেছি। ফরেনসিক রিপোর্টটি হাতে পেলে আমরা চুড়ান্ত চার্জসিটের দিকে চলে যাবো।
তবে পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয়রা মনে করছেন, তদন্তে উদাসীনতার কারণে বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। প্রশাসন ও সরকারের প্রতি তাদের জোর দাবি, দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।