শরতের নীল আকাশ। উপরে সাদা মেঘের দলা উড়ে যায়। কাঠফাঠা রোদের মাঝে ফুরফুরে বাতাস বইছে। মাঠ থেকে আসছে কাঁদা মাটির সোধা ঘ্রাণ। ধানী জমির মাঝে বিস্তৃত এলাকা পলিথিনের শেড। ভেতরে আইল করে লাগানো টমাটো গাছ। গাছের ডগায় থরে বিথরে ঝুলে আছে লাল সবুজ টমাটো।পাখি পোকামাকড় থেকে পাকা টমাটো রক্ষায় জাল দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। এমন দৃশ্য দেখা যায় কুমিল্লা বুড়িচং উপঝেরার কোরপাই গ্রামে। এই গ্রামের কৃষক মোঃ মোবারক হোসেন জংলি বেগুনের সাথে গ্রাফটিং করে টমাটো চাষে কোটিপতি হয়েছেন।
কুমিল্লা কৃষি অফিসসূত্রে জানা যায়, পথের পাশে কিংবা ঝোপের মধ্যে জন্ম হয় জংলী বেগুনের। সেই ফেলনা বেগুনের চারার সাথে টমেটোর চারার জোড়া (গ্রাফটিং) লাগিয়ে জন্ম নেয়া চারা রোপণ করেন মোবারক হোসেন। বছর চারেক আগে তার এই কাজ দেখে অনেকেই পাগল বলে আখ্যায়িত করেছিলো। এখন সমালোচকরাই টমেটোর চারা তৈরি ও চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, সাড়ে ৩ একর জমিতে গ্রাফটিং করা টমেটার চাষ করা হয়েছে। ওপরে পলিথিনের শেড দেয়া। পলিথিনের ওপর সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। জনা দশেক পুরুষ ও নারী টমাটোর জমি পরিচর্যা করছেন। জমিতে লাগানো হয়েছে জৈব বালাইনাশক হলুদ ট্র্যাপ। গ্রীষ্মকালীন টমেটো পরিপক্ক হওয়ার পর বিক্রি শুরু হয়েছে। পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি ধরে।
মোবারক হোসেন জানান, বছর চারেক আগে পথের পাশে জন্মানো জংলী বেগুনোর সাথে টমাটোর গ্রাফটিং করে শুরু করি। তখন আমার কাজ দেখে অনেকে পাগল বলে সম্বোধন করেছিলো। তবে আমি লেগেছিলাম বলে এখন সবাই আমার সফলতা দেখছে। আমার বাড়িতে এখন চারা তৈরি শেডে গ্রাফটিং করা হয়। শুধু তাই নয়, মোবারক হোসেন বলেন, এক দশক ধরে তিনি ফসল উৎপাদন,মাছ চাষ ও গরু পালন করছেন। গত চার বছর ধরে তিনি জংলি বেগুনের সাথ টমোটোর জোড়া লাগিয়ে চারা তৈরি করছেন। এই কাজ শুরুর পর অনেকে হাসাহাসি করেছেন। এখন সফলতা দেখে অন্যরাও আগ্রহী হয়েছেন। প্রতিটি চারা পাইকারি ১৫টাকা করে বিক্রি করছেন। তিনি ৬লাখ চারা বিক্রি করেছেন। মাঠে সাড়ে ৩একর জমিতে সাহু ও কানসাল জাতের টমেটা লাগিয়েছেন। তিনি বিষমুক্ত উপায়ে চাষ করেছন। তার চারা,মাচা.মালচিং, সার ও শ্রমিক মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৪০ লাখ টাকার মতো। তিনি আশা করছেন বিক্রি অর্ধ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া তিনি শীতকালীন আগাম টমেটো চাষের জন্য মঙ্গল রাজা নামের টমেটোর চারার গ্রাফটিং করছেন। সেগুলো আরো সাড়ে তিন একর জমিতে চাষ করবেন।
মোবারকের নির্দেশে চারা গাছের কাজ করেন জাহিদ হোসেন। জাহিদ জানান, তিনি উদ্যোক্তা মোবারক হোসেনের নির্দেশায় এখানে কাজ করেন। রাতে সাধারণত জংলি বেগুনের সাথে টমেটোর চারা জোড়া লাগানোর কাজটি করেন। মিনিটে তিন থেকে চারটি চারা জোড়া দেন। এক রাতে ১৮শ’-২হাজার চারা তৈরি করেন।
আবুল হোসেন বলেন, গ্রাফিটিংয়ের চারার আয়ু অন্য চারার থেকে বেশী। পোকা মাকড়ের আক্রমন থেকে রক্ষায় প্রাকৃতিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। তাই মোবারক হোসেনের টমাটো শরীরের জন্য উপকারী।
মোবারক হোসেনসহ ওই এলাকার কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে সব রকমের পরামর্শ ও সার্বক্ষনিক উপস্থিত থেকে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ফারুক আহাম্মদ ভুইয়া। তিনি বলেন, কৃষক মোবারক বেশ উদ্যমী। তাই তার জমিতে এখন ফসল হাসছে।
বুড়িচং উপজেলা কৃষি অফিসার আফরিণা আক্তার বলেন, আমরা উদ্বুদ্ধের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির চেষ্টা করছি। তাদের একজন মোবারক হোসেন। তিনি টমেটার গ্রাফটিং করে সাড়া ফেলেছেন। তার চারা বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছে। তার থেকে কৃষি বিভাগও ৭০ হাজার টাকার চারা কিনেছে। এছাড়া তার টমেটোর মাঠে আমরা বিষমুক্ত উপায়ে চাষের জন্য জৈব বালাইনাশক সরবরাহ করেছি।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, টমাটো একটি শীতকালীন সবজি। এই সবজিটি ছেলেবুড়ো সবার কাছে প্রিয়। আমরা চেষ্টা করছি টমাটো যেন গ্রীষ্মকালে চাষ করা যায়। সে চেষ্টায় আমরা সফল। তবে এ যাত্রায় আমরা এখন গ্রীষ্মকালীন টমাটো অধিক চাষে মনোযোগী হচ্ছি। যাতে করে মোবারকের মত অন্যারাও এগিয়ে আসে। তাতে সাশ্রয়ীমূল্য সারা বছর ধরে টমাটোর স্বাদ নিতে পারবে এ জনপদের মানুষজন। সে লক্ষ্য আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষনের বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। এছাড়াও কৃষকরা টমাটো চাষে এগিয়ে এলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাদেরকে সব রকমের সহযোগীতা করবে।