বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফেনীতে আবাদ হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু সবজি ঠোঁয়াস

  • মুহাম্মদ আবু তাহের ভূঁইয়া, ফেনী প্রতিনিধি   
  • ১৯ আগস্ট, ২০২৫ ২১:২৩

ঠোঁয়াস অপ্রচলিত জলজ সবজি। এটি বাংলাদেশের একটি বিলুপ্তপ্রায় সবজি। সবজি হিসেবে মাছের সাথে কিংবা ভেজে, কখনো কখনো ভর্তা হিসেবে খাওয়া যায়। স্বাদ কিছুটা শাপলার কাণ্ডের মত। শাপলার মতই কুটে বেছে নিতে হয়। ডাটা শাকের মত বললেও চলে। তারপর ধুয়ে মাছ বা ডাল দিয়ে রান্না অথবা শাপলার মত ভাজি করে খেতে অনেক স্বাদ। সবক্ষেত্রে এটি অতুলনীয় । এটি আঁশ সমৃদ্ধ হওয়ায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ লোকজন।

ঠোঁয়াস সম্পর্কে বর্তমানে অনেকে জানেন না। এ সবজি সচরাচর বর্ষাকালে পাওয়া যায়। যে সময় মাঠে তেমন সবজি থাকে না, সে সময় সবজির যোগান দিয়ে থাকে ঠোঁয়াস।

ফেনী অঞ্চলে ঠোঁয়াস সবজি বয়োবৃদ্ধ সবার কাছে পরিচিত। ষাট ও সত্তুরের দশকে এই অঞ্চলের কম বেশি সকল মজা পুকুরে ঠোঁয়াস চাষ হতো। বর্ষা মৌসুমের আগেই এই সবজি লাগানোর আদর্শ সময়। ডোবা, জলাশয়, পুকুরের পাড় সংলগ্ন কিনারায়, পরিত্যক্ত নিচু জমিতে লাগানো যায়। ফেনীর সোনাগাজী, দাগনভূঞা, সদরের কিছু অংশ ও ফুলগাজীতে জমি, পুকুর, খাল-বিলের পানিতে এর বাণিজ্যিক চাষ হয়।

বহুপূর্বে কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্রগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় বর্ষাকালে ঠোঁয়াস পাওয়া যেত। এখন ওসব এলাকায় ঠোঁয়াস উৎপাদন কমেছে।

ফেনীর প্রায় এলাকায় অগভীর জলাশয় বা মজে যাওয়া পুকুরে ঠোঁয়াস চাষ করা হয়। এটি পানির ওপর ভাসে। ২-৩ মাসে ফসল ঘরে তোলা হয়। লাভ অধিক । কোন প্রকার সার, কিটনাশক ছাড়াই চাষ করা যায় ও পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো যায়। ঠোঁয়াস গাছ এর গীটসহ কান্ড বা সাকার একবার কাদামাটিতে লাগিয়ে দিলেই হয়। এটি পানি শুকিয়ে গেলেও মাসের পর মাস মাটিতে বাঁচে। পর্যাপ্ত পরিমান পানি পেলে এই সবজি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ সবজি চাষের জন্য বিশেষ কোন পরিশ্রম নেই।

ঠোঁয়াস ফেনীর গ্রামীণ হাটবাজারে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু কিছু এলাকায় শহরের বাজারেও ঠোঁয়াস পাওয়া যায়। ফেনী শহরের বড়বাজারে (কাঁচা বাজার) কয়েকটি দোকানে ঠোয়াস পাওয়া যায়। ১২-১৪ ইঞ্চি লম্বা ২০-২২টি ডাটা নিয়েই একটি আটি। আটি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে বাজারে বিক্রি হয়। দামে কম ও সুস্বাদু হওয়ায় মানুষ এই সবজিতে অতি আগ্রহী।

ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মৃত মৌলভী আমির হোসেনের পুত্র মোহাম্মদ হানিফ। একসময় নোয়াখালীতে ব্রিক ফিল্ডে চাকরি করতেন। পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয় । তিনি সুস্থ হয়ে ২০০০ সাল থেকেই বাড়ির সামনে ১৬ শতাংশের মজা পুকুরে ঠোঁয়াস চাষ শুরু করেন। তিনি বলেন, সামান্য ঘাস, আগাছা পরিষ্কার করা হলেই ঠোঁয়াস মোটা এবং তাজা হয়। তিনি প্রতিদিনই ঠোঁয়াস তুলে পরিষ্কার করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। এতে তার লাভও ভালো হয়। এর আয় থেকে চলছে তার পরিবার। সন্তানদের পড়ালেখাসহ সবকিছু। তিনি আরো বলেন, যারা বেকার রয়েছেন, তারা তাদের বাড়ির সম্মুখে বা পার্শ্ববর্তী মজা পুকুরে বা জলাশয় ঠোঁয়াস চাষ করলে পরিবারের সবজির চাহিদা পূরণ হবে, লাভও হবে।

ফেনী জেলা শহরের বড়বাজারের সবজি ব্যবসায়ী সাবধান মিয়া, বয়স সত্তর ছুই ছুই। বাড়ি সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের চর মধুয়াই। বাড়ির সামনে ২৫ ডিসিমেল এর একটি জলাশয়ে ঠোঁয়াস চাষ করেন । নিজে পানি থেকে তুলে পরিস্কার করে বাজারে এনে নিজ দোকানে অন্যান্য সবজির সাথে বিক্রি করেন। এতে পুঁজি ছাড়া তাঁর ভালো লাভ হয়।

ফেনীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায়শ: বাজারে এই অপ্রচলিত সবজিটা খুঁজি ।কখনো পাই, কখনো পাইনা। যখনই পাই, যত দামি হোক আমি এটা কিনে বাসায় নিয়ে যাই এবং পরিবারসহ সবজি হিসেবে ভাতের সাথে খেয়ে থাকি।

গোবিন্দপুর এলাকার গৃহিণী লায়লা আক্তার রেখা ও নাসিমা আক্তার দু'জনেই ঠোঁয়াস এর নিয়মিত ক্রেতা। তাদের সাথে কথা হয় ঠোঁয়াস চাষকারী মোহাম্মদ হানিফ এর বাড়িতে। তারা বলেন, ঘরে রান্নার কোন সবজি না থাকলে আমরা প্রতিনিয়তই এখান থেকে ঠোঁয়াস পরিবারের জন্য নিয়ে রান্না করে থাকি। এটি দামেও কম পাশাপাশি রন্ধন-প্রণালীও সহজ এবং খেতেও সুস্বাদু।

স্থানীয় গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় এর সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী বিবি মরিয়ম বলেন, আমি ঠোঁয়াস খুব পছন্দ করি। আমরা পরিবারের সবাই মিলে এই সবজি খেয়ে থাকি। আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে ঠোঁয়াস খাওয়া উচিত। কারণ, আমাদের শিক্ষকগণ বলেছিলেন, ঠোঁয়াস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং এই সবজি খেলে রোগ কম হয়।

বিশিষ্ট সমাজসেবক আলহাজ্ব দীন মোহাম্মদ বলেন, আমাদের শৈশব এবং কৈশোর জুড়ে আমরা এই সবজিটি আমাদের বাড়ির আশপাশে সর্বত্রই পুকুরে দেখেছি। এটি আমার মা এবং দাদীরা আমাদেরকে সুস্বাদুভাবে রান্না করে খাওয়াতেন। এখন আর এটি তেমন একটা দেখা যায় না। আমাদের উচিত ঐতিহ্যবাহী এই সবজিটিকে টিকিয়ে রাখা।

ফেনী সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, ঠোঁয়াস একটি অপ্রচলিত বিলুপ্তপ্রায় সবজি। এটি চাষে তেমন পরিশ্রম হয় না ।বিশেষ করে বর্ষাকালে এটি উৎপাদন হয়। যখন মাঠে অন্যান্য সবজি থাকে না, তখন এই সবজিটি সাপোর্ট দিয়ে থাকে। এটি রন্ধন প্রণালীও সহজ । আশ সমৃদ্ধ হওয়ায় ঠোঁয়াস ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটা যদি সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে মানুষের বেশ উপকার হবে।

এ বিভাগের আরো খবর