গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার অন্যতম সহযোগী ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার বহুল বিতর্কিত রায়ই শেখ হাসিনাকে দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করার সুযোগ করে দিয়েছিল।
দেশের গণতন্ত্র ধ্বংসকারী সাবেক এই প্রধান বিচারপতি এখন কারাগারে। গত বৃহস্পতিবার সকালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া এই বিচারকের গ্রেপ্তারে দেশজুড়ে গণতন্ত্রমনা মানুষের মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস বইছে। এছাড়া বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি খায়রুল হককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মোতে, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এই গ্রেপ্তার জাতির ইতিহাসে বড় সাফল্যের ঘটনা হিসাবে জায়গা করে নেবে। একইসঙ্গে এ গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেল-অন্যায় করে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কেউ কোনোদিন রেহাই পাবে না।
জানা গেছে, বিচারপতি খায়রুল হকের নামে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় পৃথক দুটি মামলা রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরও দুটি মামলা আছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের হাত ধরেই দেশের বিচারাঙ্গন কলুষিত হয়। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সব অপকর্মের বীজ বপন করে গেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করাসহ খালেদা জিয়াসহ জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা এবং জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করে দেন। এর ফলে শেখ হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিনা ভোটে টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এজন্য আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনকে দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে খায়রুল হককে ‘জনক’ বলা যেতে পারে। এর বিনিময়ে তিনি আওয়ামী লীগ আমলে আইন ও রীতি লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে নানা সুবিধাও নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকায় নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন এবিএম খায়রুল হক।
এরপর দুজনকে ডিঙিয়ে দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে এবিএম খায়রুল হক শপথ নেন ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় পরের বছর ২০১১ সালের ১৭ মে অবসর গ্রহণ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে খায়রুল হক ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলে ১৩ আগস্ট তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছিল না।
এছাড়া বিতর্কিত একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তিনি দেশের বিচারব্যবস্থাকে চরমভাবে বিতর্কিত ও ধ্বংস করে গেছেন।
সর্বোচ্চ আদালতে দলবাজির ন্যক্কারজনক নজির সৃষ্টি করে গেছেন বিচারপতি খায়রুল হক। দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতির বিপরীতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে কাজ করে গেছেন। তার দেওয়া একটি পূর্ণ ও একটি সংক্ষিপ্ত রায়ের অজুহাতে শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধনের নামে গোটা সংবিধান তছনছ করে দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার ইঙ্গিতে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে মামলার বিতর্কিত রায় দেন। অবসরে যাওয়ার কিছুদিন আগে ২০১১ সালের ১০ মে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশটি দেন। রায়ে বলা ছিল, ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। অথচ সুদীর্ঘ ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত রায়ের চূড়ান্ত লিখিত আদেশে বিচারপতি খায়রুল হক কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে বলে নির্দেশনা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়ে স্বাক্ষর করেন। লিখিত এই রায়ে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে—বিষয়টি ছিল না। অবসরে গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজের দেওয়া আদেশ কোনো রকম অতিরিক্ত শুনানি ছাড়াই পাল্টে দেন, যা ছিল নজিরবিহীন এবং বিচারদর্শনের গুরুতর লঙ্ঘন। এতে তিনি বিচারপতির যে শপথ নিয়েছিলেন তা লঙ্ঘন করেছেন। একটি স্বৈরাচারী রেজিমকে টিকিয়ে রাখতে যা যা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়, তার সবই তিনি করেছেন।
২০১১ সালের ৩০ জুন বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস হয়। এ আইনের ২০ ও ২১ ধারাবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ উন্মুক্ত করে। এর ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’, ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালে ‘ডামি নির্বাচনের’ প্রহসন করেন। খায়রুল হকের রায়ের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ওই তিনটি তামাশার নির্বাচনের আগের তিন মাস নিজেকে কথিত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবি করতেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর তাকে আদালতে হাজির করা হলে শুনানিতে কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ঢাকা বার ইউনিটের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম বলেন, তিনি হাসিনার ক্রীতদাস ছিলেন। হাসিনার নির্দেশে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন। সেই অবিচারের ফলে তিনি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। হাসিনার সব মামলায় তাকে যুক্ত করা হোক সেই প্রত্যাশা করছি।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক দিদার বলেন, তিনি কলঙ্কিত প্রধান বিচারপতি। তার কারণে দীর্ঘ ১৭ বছর হাজার হাজার মানুষ নির্যাতন, গুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন। তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়। তার কারণেই শেখ হাসিনা স্বৈরাচার হয়েছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম বলেন, এমন একজন লোক কিভাবে প্রধান বিচারপতি হয় সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি প্রধান বিচারপতির জায়গাটা কলঙ্কিত করেছেন। তিনি ছোট থেকেই অনেক পাপী ছিলেন। শুনানি শেষে একদল আইনজীবী তার ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় অনেককেই বলতে শুনা যায়, একজন বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক যে অপরাধ করেছেন তাকে কমপক্ষে একশ বার ফাঁসি দেওয়া উচিত। তারা বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে যত রাজনৈতিক হত্যা ও গুম হয়েছে তার জন্য বিচাপতি খায়রুল হক দায়ী। কেননা, তিনি শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হওয়ার লাইসেন্স দিয়ে গেছেন।