বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চামড়ার বাজারে এবারও হতাশা, গোড়ায় গলদ রেখে দাম নির্ধারণ

  • ইউএনবি   
  • ১১ জুন, ২০২৫ ১১:৫০

এবারের ঈদুল আজহায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার বর্ধিত নতুন দাম নির্ধারণ করে দিলেও নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হয়নি বলে অভিযোগ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, মূল সমস্যা সমাধান না করে চামড়ার দাম বাড়ালেই বাজার চাঙ্গা হবে না।

কোরবানির প্রথম ৭২ ঘণ্টায় ঢাকার বাজারে সবচেয়ে বেশি চামড়া এসেছে লালবাগের পোস্তায়। কাঁচা চামড়ার এ আড়তে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা শহরের নানা জায়গা থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছেন চামড়া। তবে তাদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না তারা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন দর অনুযায়ী, এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

ট্যানারির হিসাব অনুযায়ী, ৩০ বর্গফুট কিংবা এর চেয়ে বেশি আকারের চামড়াকে বড়, ২০ বর্গফুটের ওপরের চামড়াকে মাঝারি এবং ২০ বর্গফুটের নিচের চামড়াকে ছোট চামড়া হিসেবে ধরা হয়।

এ হিসাবে সর্বনিম্ন দাম ধরলেও একটি বড় চামড়ার দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ১৫ ফুটের ছোট চামড়ার দাম হয় ৯০০ টাকা। কিন্তু মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় চামড়া বিক্রি করতে পারছেন। এর চেয়ে বেশি দামে কোনোভাবেই চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।

চামড়া ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, ‘কোরবানির দিন বিকালে প্রতি পিস চামড়া ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছি। ৯০০ টাকা দাম বলে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও ক্রেতা পাওয়া যায়নি।’

একই অভিযোগ জানিয়ে আরেক মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মিলন সরকার বলেন, ‘কেউ ফুট মেপে চামড়া কেনেনি। পিস হিসেবে গড়পড়তা ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায় চামড়া বিক্রি করেছি। সরকার দাম বাড়িয়েছে শুনে মাদরাসা–লিল্লাহ বোর্ডিং থেকে বেশি দামে চামড়া কিনে বড় বিপদে পড়তে হয়েছে।’

কেন সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা হচ্ছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে পোস্তার আড়তদাররা জানান, এবার চামড়ার বাজার আগেরবারের চেয়েও খারাপ। নির্ধারিত দামে চামড়া কিনলে লোকসান দিয়ে ট্যানারির কাছে চামড়া বিক্রি করতে হবে।

এ বিষয়ে কাঁচা চামড়ার সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, ‘যারা চামড়ায় অর্থলগ্নি করত, এবার তাদের অনেকেই এ ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী আগের সরকারের রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তারা পলাতক। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের হাতে নেই নগদ টাকা। আগে যে ব্যবসায়ী ১০ হাজার পিস চামড়া কিনতেন, এবার তারা কিনছেন ৫ হাজার পিস করে।’

এ ছাড়া পোস্তায় প্রচুর নষ্ট চামড়াও এসেছে উল্লেখ করে টিপু বলেন, ‘৩০ শতাংশেরও বেশি চামড়া পচে গেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণ না লাগিয়ে কাঁচা চামড়া নিয়ে এসেছেন। বিক্রি করতে করতে অনেক চামড়া হয় পচে গেছে, না হলে মান হারিয়েছে। সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণ না দিয়ে চামড়া এনেছেন। এতেও দাম অনেক কমেছে।’

ঈদের তৃতীয় দিন সাভার চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান জানান, সরকারের পক্ষ থেকে চামড়া সংরক্ষণে ৩০ হাজার টন লবণ বিতরণ করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের লবণ বিতরণের পরেও কেন তারা লবণযুক্ত চামড়া আড়তে আনেননি—এমন প্রশ্নের জবাবে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার শুধু আড়তে লবণ দিয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই জানেন না যে কোথা থেকে বিনামূল্যে লবণ সংগ্রহ করতে হয়। তাই অনেকেই লবণ না পেয়ে নিজে টাকা দিয়ে কিনেছেন, অনেকে আবার লবণ না লাগিয়েই চামড়া আড়তে নিয়ে গেছেন।’

সরকারের দেওয়া বিনামূল্যের লবণ পাননি উল্লেখ করে আরেক ব্যবসায়ী সুমন মৃধা বলেন, ‘নিজেই লবণ কিনে চামড়ায় লাগিয়েছি। একেকটি বড় সাইজের গরুর চামড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকার লবণ দিতে হয়। ছাগলের চামড়ায় কম করে হলেও ৫০ টাকার লবণ লাগে।’

এদিকে, সোমবার যশোরের সবচেয়ে বড় চামড়ার মোকাম রাজারহাট পরিদর্শন শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, ১৫ বছর ধরে চামড়া শিল্পে নৈরাজ্য চলছে। একদিনে চামড়া শিল্পের এত বড় সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। কাঁচা চামড়া রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দেশে দাম না পেলে বিদেশে চামড়া রপ্তানি করতে পারবেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া রপ্তানি একেবারেই অসম্ভব; এমনকি দেশে যেসব চামড়ার আড়ত আছে, তাদের সিংহভাগের রপ্তানি সক্ষমতা নেই বললেই চলে—এমন মন্তব্য করে বিএইচএসএমএর মহাসচিব বলেন, ‘রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে সরকার যদি মনে করে যে কাঁচা চামড়া রপ্তানি চাট্টিখানি ব্যাপার, তাহলে তারা ভুল ভাবছেন। চামড়া রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করতে যে পরিমাণ শ্রম এবং সক্ষমতা লাগে, তার কিছুই আড়তদারদের নেই।’

‘দাম না পেলে চামড়া রপ্তানি করুক—এ ধরনের কথা এক ধরনের হঠকারিতা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দোষ কি সিন্ডিকেটের, নাকি সমন্বয়ে গলদ?

এপেক্স ট্যানারির চামড়া বিভাগে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করেছেন নজরুল ইসলাম খান। ট্যানারিটির সাবেক এই মহাব্যবস্থাপক বলেন, ‘কোরবানির ঈদ এলেই সিন্ডিকেটের কথা তোলা হয়, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এত বছরেও সরকার দেখাতে পারল না কারা আসলে সিন্ডিকেট করে। বাস্তবিক অর্থে চামড়ার বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। মূল সমস্যা সমন্বয়ে।’

‘সরকারের নীতির সঙ্গে ট্যানারি মালিকদের অনেক ক্ষেত্রে যোগসাজশ থাকে না। আড়তদারদের কথা শোনার কেউ নেই। আর এই বাহাত্তর ঘণ্টায় যারা চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন, এত বছরেও তাদের দেওয়া হয়নি কোনো প্রশিক্ষণ, জানেন না চামড়া কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়।’

নজরুল বলেন, ‘সকালে পশু কোরবানি হলে নিয়ম দুপুরের মধ্যে আড়তে চামড়া নিয়ে যাওয়া এবং বিকালে আড়ত থেকে ট্যানারিতে তা স্থানান্তর করা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্যানারিতে চামড়া আনতে আনতে রাত দশটা–এগারোটা বেজে যায়। সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণ না করে এত দীর্ঘ সময় বাইরে রাখার কারণে চামড়ায় পচন ধরে, ফলে মান কমে যায়। বিশেষ করে রাত ১২টার পর ট্যানারিতে যেসব চামড়া আসে, তার সিংহভাগই থাকে পচা ও নিম্নমানের।’

সরকারের সঙ্গে ট্যানারি মালিকদের সমন্বয়হীনতা প্রসঙ্গে খাতটির মালিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ফুটপ্রতি চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, সেটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় না মেনে নিজের মতো দাম নির্ধারণ করেছে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে দাম দিয়েছে তা লবণযুক্ত চামড়ার। আমরা ট্যানারি মালিকরা সরাসরি কাঁচা চামড়াও কিনি। এবার সারা দেশ থেকে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা, সেখানে কাঁচা চামড়া কিনেছি ৩ লাখ ৭৫ হাজারটি। এই কাঁচা চামড়ার দাম কী হবে, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ধরনের নির্দেশনা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশন থেকে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণের কথা উঠলেও আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়। এতে করে বিপদে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ট্যানারি মালিকদের দেওয়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ছোট সাইজের লবণযুক্ত চামড়ার দাম সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩৫০ টাকা। সে হিসাবে ১৭ ফুটের ছোট চামড়ার দাম বর্গফুটপ্রতি পড়ে প্রায় ৮০ টাকা, যা আবার নির্ধারিত মূল দামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাস্তবতা বিবর্জিত নানামুখী এ ধরনের সিদ্ধান্তে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা শুরুতে খুশি হলেও পরে এসে আবারও হতাশ হতে হয়েছে তাদের।’

চামড়া খাতের গোড়ায় গলদ

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার, যা সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে হয়েছে ৯৬ কোটি ১৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

দিন দিন কেন এ খাতে রপ্তানির বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে—সে প্রসঙ্গে চামড়া রপ্তানিকারক ইমা লেদার এক্সপোর্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবুল হোসাইন বলেন, ‘২০১৭ সালে রাজধানী থেকে ট্যানারি হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের পর এখন পর্যন্ত এসব ট্যানারি এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সার্টিফিকেট পায়নি। এ সনদ না থাকার কারণে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি একরকম বন্ধ হয়ে আছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের চামড়া রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার চীন। অল্প কিছু চামড়া ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে যায়। পশ্চিমা বাজার ধরতে না পারায় এ খাত থেকে ব্যবসা গুটিয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে (এসটিআইই) নির্মিত সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) এখনো কার্যকর হয়নি। এই প্ল্যান্ট পুরোপুরি কার্যকর না হলে এলডব্লিউজি সনদ মিলবে না। মূলত এই সনদের অভাবেই বিদেশে বেশি দামে চামড়া বিক্রির সুযোগবঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন ট্যানারি মালিকদের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ‘চামড়া রপ্তানিতে আমরা চীনের কাছে জিম্মি। চীনের ব্যবসায়ীদের একটি বড় সিন্ডিকেটের কাছে আমরা বাধ্য হয়ে একেবারে কম দামে চামড়া বিক্রি করছি। যেখানে প্রতি বর্গফুট চামড়া ১ ডলার ২০ সেন্টে বিক্রি করার কথা, সেখানে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬০ সেন্টে।’

তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ঠিক করে দিলেও এ দামে চামড়া কিনে রপ্তানি করতে গেলে প্রতি বর্গফুটে বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম পাওয়া যাবে ৭০ টাকার মতো; ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও কম।’

প্রস্তুতকৃত চামড়ার রপ্তানিমূল্য এত কম হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কম দামে চামড়া কিনতে হয় ট্যানারি মালিকদের। সিইটিপি ঠিক না করে স্থানীয় বাজারে চামড়ার দাম বাড়ালেও স্বাভাবিকভাবেই তাই সুবিধাবঞ্চিত হবেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি এ খাত মুখ থুবড়ে পড়বে বলে শঙ্কা ট্যানারি সংশ্লিষ্টদের।

এ বিভাগের আরো খবর