মানিকগঞ্জের শান্ত, স্নিগ্ধ জনপদ সাটুরিয়া, যেখানে ধলেশ্বরী নদীর রূপালী ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরের সবুজ প্রান্তরে। এই মনোরম প্রকৃতির বুকেই ঘটে গেছে এক নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব। উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের গোপালপুর নামের একটি বাজার, যা এখন দুগ্ধ অর্থনীতির এক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় আট থেকে দশ লাখ টাকার তরল সম্পদ দুধ এখানে হাতবদল হয়। আর দুধের ব্যবসা এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের জীবনযাত্রায় এনেছে পরিবর্তন।
উপজেলার রাজৈর, বরাইদ, ধুনট, কাকরাইদসহ বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা কৃষিকাজের পাশাপাশি গাভী পালন করেন। প্রতিটি পরিবারে গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩৫ কেজি দুধ উৎপাদিত হয়। এই দুধই গোপালপুর বাজারে চলে আসে বিক্রির জন্য।
নদীর দুই কুলের প্রায় ১৫টি গ্রামের কৃষক-কৃষাণীর দৈনন্দিন জীবন আবর্তিত হয় দুধকে কেন্দ্র করে। সকাল হলেই কেউ মাথায় দুধের ভারী কলসি, কেউবা হাতে ছোট বালতি নিয়ে গোপালপুর বাজারের দিকে এগিয়ে চলেন। খেয়া নৌকার দোলানিতে নদী পার হয়ে, সবুজ মাঠের বুক চিরে তাদের গন্তব্য একটাই ধলেশ্বরীর পূর্বপাড়ের গোপালপুর বাজার।
এ বাজারে প্রতিদিন বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ দুধ, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেছে। মাসে এই বাজারে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার দুধের বেচাকেনা হয়।
এই দুধের প্রবাহ শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকেই সচল রাখছে না, বরং তা ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলায়, যেখানে গোপালপুরের খাঁটি দুধ পৌঁছে দিচ্ছে মিষ্টির স্বাদ আর পুষ্টির সম্ভার।
গোপালপুর বাজারের ইতিহাস
গোপালপুর বাজারটি গড়ে ওঠে ১৯৮৫ সালে। আশির দশকের শুরুতে গোপালপুর বাজারের আশে পাশে কোনো বাজার ছিল না। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার জন্য উপজেলা সদর অথবা পার্শ্ববর্তী দরগ্রাম বাজারে যেতে হতো। এতে কৃষকদের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। ১৯৮৫ সালে গোপালপুর বাজারে বরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান গাজী মোহাম্মদ আব্দুল হাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে জমি কিনেন। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে এখানে তিনি বাজার বসানোর ব্যবস্থা করেন। প্রথমে গ্রামীণ কৃষিপণ্য ও দুধের লেনদেন সীমিত থাকলেও নব্বই দশক থেকে দুধের ব্যবসা বড় পরিসরে শুরু হয়। আশে পাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকরা দুধ আনতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এ বাজারে পরিধি বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে বাজারটি দেশব্যাপী ‘দুধের বাজার’ নামে পরিচিত।
বরাইদ ইউপি চেয়ারম্যান গাজী মোহাম্মদ আবদুল হাই স্মৃতিচারণ করে বলেন, নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে জমি কিনে তিনি এই বাজার স্থাপন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তা জনগণের কল্যাণে দান করে দেন। আজ গোপাল পুরের দুধের বাজার শুধু মানিকগঞ্জ নয়, সারা দেশে এক বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।
গাভী পালন: আয়ের উৎস
সাটুরিয়া উপজেলার রাজৈর, বরাইদ, ধুনট, কাকরাইদ, গালাসহ আশেপাশের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। ধান, গম, ভূট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির আবাদ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এই এলাকার মানুষের অন্যতম আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে গবাদিপশু পালন। প্রায় প্রতিটি পরিবারে ২ থেকে ১০টি গাভী রয়েছে। বর্তমানে দুধ বিক্রি করে এই এলাকার বেশিরভাগ পরিবারের জীবিকা চলে। সকাল ৮টার মধ্যে দেশীয় পদ্ধতিতে দুধ সংগ্রহ করে গোপালপুর বাজারে নিয়ে যান তারা।
গোপালপুর বাজারে একদিন
সম্প্রতি সরেজমিনে গোপালপুর বাজারে সকাল সাড়ে ৭টায় গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকরা দুধ বিক্রি করার জন্য আসতে শুরু করেছেন। তখনো বাজার ভরে ওঠেনি। ধলেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড়ে আসতে শুরু করেছেন কিষাণ- কিষাণিরা। অপেক্ষা করছেন খেয়া পার হয়ে গোপালপুর বাজারে আসার। খেয়া নৌকায় নদী পারাপার হওয়ার পর নদীর পাড় ঘেঁষা পথে ছুটতে থাকেন তারা। প্রায় ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর গোপালপুর বাজারে পৌছান।
সকাল ৮টার মধ্যে আশেপাশের গ্রামের শত শত কিষাণ-কিষাণির পদচারণায় ভরে ওঠে বাজার। দুধের পাইকারি ব্যবসায়ীরা দুধ পরখ করে দেখেন। দামদর মিলে গেলে দুধ কিনে নিচ্ছেন। কেনার পর দুধ বড় বড় গ্যালনে ভরে পিকআপ ভ্যানে করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই শেষ হয় এই বাজার। কৃষক দুধ বিক্রি করার পর গরুর জন্য কিনছেন খাবার। লাভের টাকা দিয়ে পরিবারের জন্য মাছ, বিভিন্ন সবজিসহ দৈনন্দিন বাজার।
কথা হয় গোপালপুর বাজারে দুধ বিক্রি করতে আসা বরাইদ গ্রামের কৃষক মো. আক্কাস আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, তার চারটি গাভী থেকে প্রতিদিন ২৫ কেজি দুধ পান। প্রতি কেজি দুধ বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকায়।
কাকরাইদ গ্রামের কৃষক মো. সিরাজ মিয়া বলেন, ‘আমার বাড়িতে মোট ৮টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি গাভী ও ২টি ষাঁড় গরু। আমি প্রতিদিন প্রায় ৩৫-৪০ কেজি দুধ পাই। সম্পূর্ণ দেশীয় খাবার গরুকে খাওয়ানো হয়। তাই দুধের মান ভালো থাকে। আমার মতো অনেকেই রয়েছে দুধ বিক্রি করে সংসার চালায়।’
সমস্যা: একটি সেতুর অভাব
ধলেশ্বরী নদীর দুই পাড়ের স্থানীয়রা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছেন। সেতু না থাকায় নৌকায় নদী পার হতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ। আবার উৎপাদিত কৃষি পণ্য নিয়ে আসতে প্রতিনিয়ত বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
বরাইদ গ্রামের কৃষক রাসেল মিয়া বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি ব্রিজের (সেতু) দাবি জানিয়ে আসছি। ব্রিজটি হলে দুধ নিয়ে বাজারে যেতে এত কষ্ট করতে হতো না।’
গোপালপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন বলেন, প্রতিদিন গোপালপুর বাজারে ২৫০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি হয়, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বেশি। পাইকাররা এই দুধ কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। ধলেশ্বরী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হলে নদী পাড়ের মানুষের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে এবং বাজারের কার্যক্রম আরও সহজ হবে।