সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে ২৫টির সঙ্গে একমত ও ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত এবং বাকিগুলোতে দ্বিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে বিশেষ করে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এছাড়া সুপারিশগুলো ‘স্প্রেডশিট’ আকারে পাঠিয়ে হ্যা-না মতামতের প্রক্রিয়া বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়েও দলটির পক্ষ থেকে মতামত দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপের বিরতিতে এসব বিষয় গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে স্প্রেডশিটের ‘বিস্তর ফারাক’ তারা দেখতে পেয়েছেন। ‘স্প্রেডশিটে সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ/না জবাব দেওয়ার জন্য যে কাগজগুলো দিল, তাতে করে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, মিস লিড করা হয়েছে। স্প্রেডশিট দিয়ে আমাদের উনারা বিভ্রান্ত করেছেন, মিস লিড করেছেন। এটা দেওয়া উচিত হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম এ সদস্য জানান, দলের পক্ষ থেকে তারা সুপারিশের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার সংক্রান্ত হার্ড কপি জমা দিয়েছেন। সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগ, নির্বাচনসহ সব বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে। বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে সিরিয়াস বলে এ সময় উল্লেখ করেন তিনি। বিচারবিভাগের সংস্কারে ৮৯ দফা নিয়ে মতামত জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছু সাংবিধানিক হওয়া উচিত। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা চাই। প্রক্রিয়াটা যেন সাংবিধানিক হয়। বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে বেশিরভাগই সংশোধনী দিয়েছে। এনআইডি, সীমানা নির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই থাকা উচিত।’
সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে এর মাত্র ৭০ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের ২৫টি প্রস্তাবে একমত, ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত। বাকি বিষয়গুলোতে একমত হতে পারেনি। আমরা যে সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব।
বিচার বিভাগের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনে ‘মিস লিড’ করার অভিযোগ তুলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিস্তারিত প্রতিবেদনের ১৫০টি মতামতের মধ্যে ৮৯টির বিষয়ে মতামত দিয়েছি। বাকিগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হওয়া বা মন্তব্যসহ একমত হওয়ার কথা জানিয়েছি। যেসব বিষয়ে ‘হ্যাঁ/ না’ তে মতামত চাওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে বিস্তারিত প্রতিবেদনের ‘বিস্তর ফারাক’। কেননা সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের সংশোধনী ব্যতিরেকে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা ততক্ষণ পর্যন্ত অসাংবিধানিক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সংবিধানে গৃহীত হচ্ছে। এছাড়া ‘১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রইবে। বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘন সমুচিত হবে না।’ বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় জানিয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘প্রক্রিয়া যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়, সেজন্য বিস্তারিত মতামত দেব। লিখিতও দিয়েছি।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অধিকাংশ বিষয় ‘সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত’– মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কিছু বিষয়ে তারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা বজায় থাকবে না।’ যদিও বিএনপির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, প্রয়োজনে আরও আলোচনা হবে। কারণ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগাচ্ছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দলে বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। এ দলে আরো ছিলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সদস্য ব্যরিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে বিএনপির সঙ্গে কমিশনের বৈঠক শুরু হয়।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের হাল ধরা অন্তর্র্বতী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়। এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। পরে মতামত তুলে ধরে ৩৪টি দল, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন।
বৃহস্পতিবার বিএনপির সেঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এদেশে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে, ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে; সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সংগ্রাম করেছে, বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা; যাতে করে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’