বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, আর এই পণ্যের বড় গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক হার বাংলাদেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হওয়াটা স্বাভাবিকই।
কিন্তু সেই মাথাব্যথাটা আরও বাড়ে, যখন সেই বাজারে বাংলাদেশের অন্য প্রতিযোগীদের ওপর শুল্ক হারে বিভিন্নতা থাকে। যদি বাংলাদেশের চেয়ে শুল্ক হার বেশি হয়, তাহলে নতুন সুযোগ তৈরি হয়। যেমন চীনের ওপর বেশি শুল্ক ধার্য করায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা খুশি হয়েছিলেন গত জানুয়ারিতেই।
চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ। তাদের ওপর বাড়তি শুল্কের পর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি গিয়েছিল বেড়ে। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা পালে হাওয়া দেখছিলেন। কিন্তু সেখানে বজ্রাঘাত এল বুধবার; যখন ট্রাম্প শতাধিক দেশের জন্য পাল্টা শুল্ক আরোপ করলেন বিভিন্ন হারে।
তাতে চীনের পাশাপাশি ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক ধরা হলেও বাংলাদেশের চেয়ে শুল্ক কম ধরা হয়েছে ভারতের। আর এতেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের একজন ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। কারণ তিনি দেখছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন বাংলাদেশকে টপকে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে ভারতের। পারভেজ বলেন, এমনিতেই গত বছর থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য বায়ারদের কাছ থেকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছিলেন তারা। এখন যোগ হলো শুল্ক। আর এতে ভারতের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।
ভারতে রপ্তানিকারকদের সংস্থা ফিকোর মহাপরিচালক অজয় সাহা বলেছেন, ‘আমরা নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তবে অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমরা কিছুটা ভালো অবস্থায় আছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন ও ভিয়েতনামের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। তার ঠিক এক ধাপ নিচে অর্থাৎ চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। একই বাজারে ভারতের রপ্তানি ছিল ৪৬৯ কোটি (৪.৬৯ বিলিয়ন) ডলার। গত বছর ভারতের রপ্তানি তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি হয়েছিল। ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে সম্পূরক শুল্ক বসিয়েছেন ২৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে তিনি খাতির করেছেন, তাও অকপটে জানিয়েছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, “নরেন্দ্র মোদী আমার বন্ধু। সবে তিনি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু আমি তাকে বলেছি, আপনি আমার খুবই ভালো বন্ধু হতে পারেন, কিন্তু আপনি আমাদের সঙ্গে ঠিক ব্যবহার করছেন না। ভারত আমাদের পণ্যে ৫২ শতাংশ শুল্ক বসায়, আমরা ২৬ শতাংশ বসালাম।”
ভারতের পণ্যের ওপর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই শতাংশ শুল্ক বসানো ছিল। এখন তার সঙ্গে ২৬ শতাংশ যোগ হলে সব মিলিয়ে দাঁড়াবে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগেই শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ; তার সঙ্গে এখন ট্রাম্প যোগ করলেন ৩৭ শতাংশ। ফলে দুই মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য ঢোকাতে ৫২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। অর্থাৎ ১০০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করলে ৫২ ডলার শুল্ক দিতে হবে।
এটা ভারতের প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা বাংলাদেশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতের দিকে চলে যাবে বলে আশঙ্কা জাগছে দেশের পোশাক ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এর আগে চীনের পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে যে সুযোগ বাংলাদেশ নিয়েছিল, এখন তেমনই সুযোগ নিতে চাইবে ভারতের ব্যবসায়ীরা।
পারভেজ বলেন, “আমাদের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু। কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।
“এটা তো নিশ্চিত যে এই শুল্ক আমাদের রপ্তানির ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। এখন কতটা পড়বে, তা নিয়েই আতঙ্কিত আমরা।”
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা যেমন আতঙ্কিত, তেমননি বাংলাদেশ সরকারেরও শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে এই তৈরি পোশাক। সঙ্কটের মধ্যে এই খাতই ডলারের জোগানের বড় উৎস।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ে ৮০ শতাংশের বেশি অবদান তৈরি পোশাক খাতের। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানেও বড় অবদান তৈরি পোশাকের।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ হাজার ৯২৬ কোটি (৭৯.২৬ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি হয়েছিল। এই বাজারে শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে- চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
বাংলাদেশের পরের স্থানে থাকা ভারতের গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ৪৬৯ কোটি (৪.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের। তাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ট্রাম্প ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। আগের আড়াই শতাংশ যোগ করলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় তাদের ওপর আরোপিত শুল্ক কম। আবার দেশটির সরকার তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছে বলে ভারতে ক্রয়াদেশ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার দেশ। ২০২৩-২৪ সালে ৭ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য ভারত রপ্তানি করেছে। ভারত থেকে তৈরি পোশাক ছাড়াও ওষুধ, টেলিকম যন্ত্রাংশ, দামি ও মাঝারি দামের পাথর, পেট্রোলিয়াম পদার্থ, সোনা ও অন্য ধাতু, লোহা-ইস্পাতের মতো পণ্য বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
ট্রাম্পের শুল্কের বড় প্রভাব পড়লেও এখনই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিতে ধস নামবে বলে মনে করেন না বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই নীতি টেকসই হবে কি না, সেটা নিশ্চিত নয়। কারণ, বাড়তি শুল্কের চাপ শেষ পর্যন্ত তাদের ভোক্তার ওপর পড়বে। ফলে তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে।”
তবে পারভেজ বলেন, “এই অতিরিক্ত শুল্কের চাপে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের প্রথমেই পোশাকের দাম কমানোর ওপর চাপ দিতে পারে। এখন যে ক্রয়াদেশ আছে, সেগুলোর দামও কমাতে বলতে পারে। ফলে সম্মিলিতভাবে সেই চাপ সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।”
বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত কৌশল নির্ধারণ করতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।