তথ্য যাচাইকারী সংস্থা রিউমার স্ক্যানার এক অনুসন্ধানে সামাজিকমাধ্যমের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে।
ভিডিওটিতে পুকুর বা খাল থেকে রাতে আহত অবস্থায় উঠে আসা এক নারীকে দেখানো হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে মুসলিমরা একজন হিন্দু নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে।
এ নিয়ে অনুসন্ধান শেষে শুক্রবার রিউমার স্ক্যানার তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়, ‘আমরা নিশ্চিত করছি যে, ভিডিওতে থাকা ওই নারী হিন্দু নন। তার নাম লাভলি আক্তার। তা ছাড়া নারীকে ধর্ষণের দাবিও মিথ্যা।
‘ভিডিওটি আসলে একটি পুকুর থেকে উঠে আসা একজন নারীর। তিনি ডাকাত দলের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পালানোর চেষ্টা করার পর তাকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি রাতের বেলা পুকুর বা খাল থেকে উঠে আসা আহত এক নারীর একটি ভিডিওতে দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে বাংলাদেশে মুসলিমরা একজন হিন্দু নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করছে বলে দাবি করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি হ্যান্ডেলে ক্যাপশনসহ একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়।
ভিডিওটির ক্যাপশনে লিখা ছিল, ‘নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার গ্রামে একজন হিন্দু নারীকে নির্মমভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়েছে। এ সময় মুসলিমরা তাকে নিয়ে এভাবে হেনস্ত করলেও কেউ তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেনি।’
আরেকটি হ্যান্ডেলে একই ভিডিও পোস্ট করে এর ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশে বাংলাদেশি হিন্দু নারীকে ধর্ষণ, নির্যাতন ও বিদ্রুপ করা হয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ওই পোস্টে দাবি করা হয়।
এ ক্লু ব্যবহার করে রিউমার স্ক্যানার দল অনুসন্ধান করে আড়াইহাজার টাইমস নামের একটি ফেসবুক পেজে ৫১ সেকেন্ডের একই ভিডিও ক্লিপ খুঁজে পায়।
ভিডিওটির একটি বাংলা ক্যাপশন ছিল। ফেসবুকের অনুদিত ক্যাপশনটি এরূপ : ‘আড়াইহাজারে ডাকাতির সময় জনতার হাতে নারী ডাকাত আটক। আড়াইহাজারের কাহিন্দি এলাকায় দুই ডাকাতকে আটক করেছে এলাকাবাসী। জনতা একজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এবং পুলিশ নারী ডাকাতকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে।’
এরপর আরও অনুসন্ধান চালিয়ে দলটি ঘটনার ব্যাপারে সময় নিউজের একটি প্রতিবেদনের অংশ পায়। ওই প্রতিবেদনে ভিডিওটির একটি স্ক্রিনগ্র্যাব অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে বিল্লাল (৪৫) নামের এক ডাকাত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। লাভলী নামে ডাকাত দলের এক নারী সহযোগীকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) রাতে উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের কাহিন্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জানায়, সাত থেকে আটজনের একটি দল কাহিন্দি গ্রামের ইলুমদি সড়কে একটি গাড়ি ডাকাতির প্রস্তুতি নেয়ার সময় গ্রামবাসীরা তাদের উদ্দেশ্য জানতে পেয়ে তাড়া করে। সে সময় বেশির ভাগ ডাকাত পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বিল্লাল ও লাভলী জনতার হাতে ধরা পড়ে। গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই বিল্লাল মারা যান। আর লাভলী নিজেকে বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিল্লালের মরদেহ উদ্ধার করে এবং আহত লাভলীকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত রাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় কথিত এক ডাকাতকে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। গণপিটুনিতে আহত এক নারীকে পুলিশ হেফাজতে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।’
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেন জানান, আড়াইহাজার হাইজাদী ইউনিয়নের নিহত মো. বিল্লাল ওরফে বিল্লাল (৪৫) হত্যা ও ডাকাতিসহ ৯টি ফৌজদারি মামলার আসামি ছিলেন।
গ্রেপ্তার নারী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি পেশায় একজন যৌনকর্মী এবং একই এলাকায় একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে ছিলেন। সে সময় গ্রামবাসী চিৎকার শুরু করে।
তিনি দাবি করেছেন, তিনি ভয় পেয়েছিলেন এবং পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।
ওসি বলেন, ‘তিনি (লাভলী) ডাকাত দলের সদস্য। তিনি ডাকাত দলের সদস্যদের রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করতে সাহায্য করতেন।’
ওসির মতে, চক্রটি রাস্তায় গাড়ি ছিনতাই করতে পারদর্শী এবং নারী সদস্যরা ডাকাতির সময় যানবাহন থামাতে সহায়তা করে।
তিনি বলেন, ‘এই নারীও গ্যাংয়ের একজন সদস্য।’
ওসি আরও বলেন, ‘এই নারী বহুমুখী। একবার গ্রামবাসীরা তাকে মাদক ও অনৈতিক কাজের অভিযোগে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিল।’
একজন স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘তার জীবন বাঁচাতে একটি পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিল, কিন্তু গ্রামবাসী তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে মারধর করে।’
পরে রিউমার স্ক্যানার টিম আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেনের সঙ্গে কথা বলে।
তিনি নারীটি হিন্দু, এমন দাবি নাকচ করেন এবং নিশ্চিত করেন যে, ওই নারী মুসলিম এবং তার নাম লাভলী আক্তার।
রিউমার স্ক্যানার টিম নারায়ণগঞ্জের (সি-সার্কেল) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলামের সঙ্গেও কথা বলে।
তিনিও নিশ্চিত করেছেন, ওই নারী (লাভলী) মুসলিম। তিনি রিউমার স্ক্যানারকে বলেন, ‘ওই নারী হিন্দু নন; তিনি মুসলিম। ধর্ষণের দাবি অসত্য এবং সম্পূর্ণ অপপ্রচার।’