মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে বুধবার।
আগামী রোববার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসবের।
এ উৎসবে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দুর্গাপূজাকে ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে উৎসবের আমেজ শুরু হয়েছে। সরকার নির্বাহী আদেশে বৃহস্পতিবার ছুটি ঘোষণা করেছে।
আগামী শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিসহ এবার দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে টানা চার দিনের ছুটি হতে যাচ্ছে। পরের দিন রোববার দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী উপলক্ষে সরকারি ছুটি।
সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত ছুটি থাকছে। টানা চার দিনের সরকারি ছুটি উৎসবের আমেজ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
দেশের সর্বাধিক পূজা অনুষ্ঠিত হওয়া পুরান ঢাকাতে এবারও উৎসবের আমেজে ব্যতিক্রম নেই। সর্বত্র চলছে উৎসব আয়োজনের তোড়জোড়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে এ বছর ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গাপূজা। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই এ বছর পূজা হবে ২৫২টি মণ্ডপে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পূজা উদযাপন করা হবে পুরান ঢাকায়।
এর মধ্যে সূত্রাপুর থানায় ২৬টি, কোতোয়ালি থানায় ২৪টি, ওয়ারীতে ১৮টি, গেন্ডারিয়ায় ১৫টি ও বংশাল থানায় দুটি মণ্ডপে পূজা উদযাপন করা হবে।
পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, কালী মন্দির, নর্থব্রুক হল রোড, মহাকাল শিব বিগ্রহ, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজারসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় শতাধিক প্রতিমা শিল্পী গত এক মাস নির্ঘুম সময় কাটিয়েছেন প্রতিমা তৈরিতে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত তিন বছর বড় পরিসরে আয়োজন না হলেও এ বছর তা কাটিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে পুরান ঢাকার মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে সাজ সাজ রব।
প্রতিমা শিল্পী মিন্টু চন্দ্র পাল মঙ্গলবার বলেন, ‘গত দেড় মাস ধরে প্রতিমা তৈরি করেছি। গতকাল (সোমবার) কাজ শেষ। অন্য বছরের চেয়ে এবার দুর্গার আশীর্বাদে ভালোই অর্ডার পেয়েছি।
‘বছরে এমনিতে ১৫-২০টি মূর্তি বানাই। এ বছর ৩৬টি বানিয়েছি। আগে একাই সব করতাম। এবার সঙ্গে দুজন সহকারীও নিয়েছি। তাই কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে।’
শেষ সময়ে প্রতিমায় রং-তুলির ছোঁয়া দিতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন আরেক শিল্পী পল্টন পাল। ৩৩ বছর ধরে প্রতিমা বানিয়ে আসছেন তিনি।
পল্টন গতকাল বলেন, ‘এ সময় ভীষণ কাজের চাপ, তবে প্রতিমা তৈরি শেষ। চুন-কালির প্রলেপ দিচ্ছি এখন। এ বছর মোটামুটি ভালো কাজ পেয়েছি। গত বছর করোনায় তেমন সুবিধা করতে পারিনি।’
পুরান ঢাকার ১৩৬, শাঁখারীবাজারে ৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব।
ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক ও কোতোয়ালি থানা পূজা কমিটির সহসভাপতি উৎপল কুমার ঘোষ শেখর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ২০টি পূজা হবে। তার মধ্যে দুটি পারিবারিক পূজা ও বাকি ১৮টি সার্বজনীন। এবার আমাদের ভলান্টিয়ার থাকবে, সিসিটিভি তো অবশ্যই লাগানো হবে।
‘নির্দেশনা আছে ব্যাগ-বস্তা নিয়ে কেউ মণ্ডপে যেতে পারবে না। বিকৃত মস্তিষ্ক কেউ থাকতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ থাকবে, আমরাও সর্বদা সচেষ্ট থাকব।’
নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পূজা আমাদের, রক্ষা করব আমরাই। এসবি, ডিবিসহ সাদা পোশাকে পুলিশ হাঁটাচলার মধ্যে থাকবে।
‘দেবীর সঙ্গে আমরা কারও তুলনা করি না। পূজার আরাধনার জন্যই পূজা করি। দেবীর জন্য পূজা করছি, বড় আনুষ্ঠানিকতা করছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাজেট ৮-১০ লাখ টাকা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় মন্দা। আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। সার্বিক অবস্থায় সবাই আমরা উদ্বিগ্ন। মায়ের নিকট এসবেরই পরিত্রাণ চাইব।’
তাঁতীবাজার শিব মন্দির পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বীরেন ঘোষ বীরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর মায়ের আরাধনার সব ব্যবস্থা করে থাকি। এবারও ব্যত্যয় ঘটবে না।
‘ষষ্ঠীর দিন রাতে আমরা মণ্ডপে প্রতিমা তুলব। আশা করছি আমাদের এবারের দুর্গাপূজা ভালোই কাটবে।’
কোতোয়ালি থানা পূজা কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও তাঁতীবাজার শিব মন্দির পূজা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ গগন বলেন, ‘মায়ের প্রতিচ্ছবি দিয়ে প্রতিমা করা হয়। দুর্গা মায়ের আসল রূপই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
‘দুর্গাপূজায় এবার ভক্তিমূলক গান বেশি বাজবে। কারও যেন কোনো সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা হবে।’
সঙ্ঘমিত্র পূজা কমিটির কোষাধ্যক্ষ পিয়াল নাগ বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিসিটিভি লাগাতে বলা হয়েছে। সময়মতো লাগানোও হয়ে যাবে। এবার প্রতিটি মণ্ডপের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে জানানো হয়েছে।’
নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকায় এসব কর্মকাণ্ড করার সাহস কারও নেই। অন্ততপক্ষে শাঁখারীবাজারে কেউ এসব করতে আসবে না। এমন দুঃসাহস কারও হয়নি।
‘আমরা সার্বক্ষণিক মণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। মায়ের প্রতিমা রক্ষায় সর্বদা নিজেদের নিয়োজিত রাখব।’
দুর্গোৎসবকে ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যেকোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে নেয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরই মধ্যে মণ্ডপে মণ্ডপে বসানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। বৃষ্টি থেকে প্রতিমা বাঁচাতে প্রায় সব মণ্ডপে ত্রিপলের ছাউনি তৈরি করা হয়েছে।
নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক মু. এনামুল হাসান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে শতভাগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোবাইল টিম এখন থেকেই কাজ করছে।
‘আমরা পূজা উদযাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে মিটিং করেছি। কীভাবে নির্বিঘ্নে নিরাপত্তার মাধ্যমে আমরা পূজা সমাপ্ত করতে পারব, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
দুর্গাপূজায় মণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বংশাল থানার উপপরিদর্শক আতিকুর রহমান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। আমার থানায় মাত্র দুটি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। তাও আবার এক ছাদের নিচেই। তবু পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পূজার সমন্বয়ক কমিটি করা আছে।
‘তারা সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করবে। ভলান্টিয়াররা তো আছেই। সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে।’
সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গাপূজায় আমাদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে আমাদের একজন অফিসার থাকবেন।
‘পূজা উদযাপন কমিটি ভলান্টিয়ার টিমসহ হিন্দু-মুসলিম মিলে সম্প্রীতি টিম গঠন করা হয়েছে। মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।’
আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত।