অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সরকার বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তরুণ বিপ্লবী তথা শিক্ষার্থীরা দেশের মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, তা পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা কখনোই শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।’
বৃহস্পতিবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে দেয়া বার্তায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমাদের তরুণ বিপ্লবীরা দেশের মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, তা পূরণে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শহীদদের আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাই। এক নতুন যুগের সূচনা করতে চাই।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ নিয়েছিলে। শহর ও গ্রামীণ জনপদের দেয়ালে আঁকা তোমাদের স্বপ্নগুলো এখনও নানা রঙের সাজ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিপ্লবের সময় পড়াশোনা বাদ দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ঘুমহীন রাত কাটিয়েছ এবং দিনে পরস্পরের থেকে চির বিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমেছ।
‘বিপ্লব শেষে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাদের উপাসনালয় পাহারা দিয়েছ এবং সারা দেশে ট্রাফিক পরিচালনা করার দায়িত্ব নিয়েছ। তোমাদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই এখন সময় পড়াশোনায় ফেরার।
তিনি বলেন, ‘স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে। আমি তোমাদেরকে ক্লাস ও ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। কেননা বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলতে আমাদের একটি সুশিক্ষিত ও দক্ষ প্রজন্ম দরকার।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গৌরবময় বিপ্লবের জন্য শত শত ছাত্র এবং সর্বস্তরের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। তারা ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে। শেখ হাসিনা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র এবং একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বাংলাদেশকে এর পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের।’
ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবে শাহাদাত বরণকারী সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধান উপদেষ্টা। যারা আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, কিংবা চক্ষু হারিয়েছেন, বক্তব্যে তাদের সবাইকে স্মরণ করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, ‘আমরা বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। আমাদের প্রথম কাজ জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
‘গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা এদেশে এসেছেন এবং তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
‘এ ছাড়া আমি জুলাই ও আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল করতে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছি। আমরা খুনিদের প্রত্যর্পণ এবং স্বৈরাচারের সময় যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করেছে, তা দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের প্রধান দায়িত্বগুলোর একটি হলো বিপ্লবের সময় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হাজার হাজার মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা। আমরা শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির জন্য ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছি। আহতদের চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকার রাজনৈতিক দল, সম্পাদক, ব্যবসায়ী নেতা, সুশীল সমাজের নেতা এবং কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করছে। সম্প্রতি আমরা বলপূর্বক গুম থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে স্বাক্ষর করেছি।
‘আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে বলপূর্বক গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করছি। আয়নাঘরগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
ড. ইউনূস জানান, তিনি সব শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানাবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুঃশাসন ও স্বৈরাচার দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত পূরণ করা। এজন্য আমাদের প্রয়োজন একতা ও সমন্বয়।
‘শহীদদের রক্ত এবং আহত ভাইবোনদের আত্মত্যাগকে জাতি হিসেবে আমরা কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। আজ আবারও প্রতিজ্ঞা করলাম- তাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ আমরা গড়বোই।’