টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা ফেনীর মুহুরী নদীর বন্যার পানির কারণে নোয়াখালীতে সার্বিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ।
জেলা শহর মাইজদীতে ঘরবাড়ি ও দোকানে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোথাও হাঁটু কোথাও কোমর পানি উঠায় বন্ধ হয়ে গেছে রান্নাবান্না। এ অবস্থায় বন্যার্ত মানুষগুলোর দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে।
জেলার কয়েকটি নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়ায় ওইসব এলাকার লোকজন পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয় ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। ৪ লাখ মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া গ্রামীণ সড়কে সব ধরনের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদিকে জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষক আরজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত নোয়াখালীতে ১৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সক্রিয় লঘুচাপ ও মৌসুমি জলবায়ুর কারণে জেলায় আরও তিনদিন ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে জেলার আরও নতুন নতুন এলাকায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার কয়েক লাখ মানুষ। ভেসে গেছে কয়েক শ’ মাছের ঘের, মুরগির খামার, আমনের বীজতলা, শাকসবজি ক্ষেত। ঝড়ো বাতাসে ভেঙে পড়েছে গাছপালা। খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে বেশকিছু এলাকা।
অনেকের বসতঘর ও রান্নাঘরে হাঁটু ও কোমর সমান পানি। পানির কারণে রান্নাও করতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। সবকিছু ডুবে থাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও পানির সংকট। আশপাশের নালায় জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়েছে।
জেলার সাতটি পৌরসভার বেশিরভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সবধরনের গ্রামীণ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, কবিরহাট, কোম্পানিগঞ্জ, সুবর্ণচর ও চাটখিল উপজেলা বন্যার ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। ফেনী জেলার মুহুরী নদীর বন্যার পানিতে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কাদির হানিফ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আবদুল বলেন, ‘অনেক বাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় অনেকে অনাহারে কষ্ট পাচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুখাদ্যের অভাব প্রকট।’
সদর উপজেলার কাদির হানিফ ইউনিয়নের আদর্শ স্কুল কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া রহিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছি। রাতে কিছু শুকনা খাবার দেয়া হয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে কোনো খাবার পাই নাই। কোলের শিশু সন্তানটি খাবারের জন্য কাঁদছে।’
নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘জেলায় সাত লাখ ৭৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। ভারী বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বেগমগঞ্জের একটি উপকেন্দ্রে পানি উঠে গেছে।’
নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল বলেন, ‘নোয়াখালীতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়নি।’
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, ‘নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটি উপজেলা বন্যা হয়েছে। এসব উপজেলায় ইতোমধ্যে ৩৮৮ আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৩৬ হাজার বন্যা আক্রান্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
‘জেলায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। আমাদের উপজেলার কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে নগদ টাকা ও চাল বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে আমরা চাহিদার কথা জানিয়েছি।’