রাজধানীর পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) বিদ্রোহের সময় হত্যাকাণ্ডের মামলায় যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসবের প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ এবং দিনটিকে শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন নিহত সেনা সদস্যদের স্বজনরা। এ সময় পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার-স্বজনকে সরাসরি দায়ী করেছেন তারা।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীতে রাওয়া (রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন) ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাত দফা দাবি জানান নিহত সেনা সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই যেখানে একজন সিটিং প্রধানমন্ত্রী অন্য একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করেন। এ জন্য ওই দিনটিকে আমরা শহীদ সেনা দিবস দাবি করছি।’
তিনি বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
রাকিন আহমেদ বলেন, ‘১৫ বছর যেভাবে বিচারের ট্রায়াল বা তদন্ত হয়েছে তা আমরা মানি না। কারণ প্রধান হত্যাকারী ও নির্দেশদাতা তখন ক্ষমতায় ছিলেন। খুনি কি তার নিজের বিচার করবে? মুখ বন্ধ করে দেখতে হয়েছে কেমন করে তদন্ত, ট্রায়াল প্রভাবিত করলো, ডাল-ভাতের কথা বলল। নীরবে সহ্য করতে হয়েছে।
‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দেশপ্রেমিক অনেক সেনা অফিসার বিচার চাইতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন। কেউ কেউ জেলে গেছেন। দরবারের শত শত অফিসারের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে। আমরা চাই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত সেনা অফিসারদের পরিবারকে যেন যথাযথ সম্মান ও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শহীদ পরিবার মনে করি- যেসব নির্দোষ, দেশপ্রেমিক বিডিআর সৈনিক জেল খাটছেন, সুষ্ঠু তদন্তে যেন তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এ ঘটনায় যারা নির্দোষ, এখনও জেল খাটছেন, তাদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাই।’
রাকিন অভিযোগ করে বলেন, ‘এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন- ওনার নেত্রী আমার বাবা-মাকে জবাই দিয়েছেন। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে বাবা-মার মতো আমাকেও জবাই দিয়ে দেবেন।’
নিহত মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে নাজিয়া বলেন, ‘আমাদের কষ্টের কথা যদি বলি, এখনও একই পরিস্থিতিতে যাচ্ছি। কষ্ট দূর হয়ে যায়নি। মানুষ জানুক এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে। কেন এত বছর পরও আমাদের মুভমেন্টে বাধা দেয়া হয়।’
লে. কর্নেল এনায়েতুল হকের মেয়ে নাবিলা বলেন, ‘এটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কাজ। এটা বিদ্রোহ নয়, এটা হত্যাকাণ্ড, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আমার বাবা মারা যাননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিছু অপপ্রচারের জন্য আমরা হেনস্তা হয়েছি। এতদিন ভয়ে কথা বলিনি, আজ নির্ভয়ে কথা বলছি। আপনারা আসল কারণ বের করবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে নিহত সেনা সদস্যদের স্বজনরা আরও বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আমাদের একটাই দাবি- বিচার চাই। একটা স্বচ্ছ বিচার হোক। চাপ দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। বাধার মধ্যে ১৬ বছর পার করেছি। আমরা এ বিষয়ে আর লুকোচুরি চাই না।’
সংবাদ সম্মেলনে নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান সাত দফা দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলো হলো-
১. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে পূর্বে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের রিপোর্ট পাবলিক করতে হবে।
২. হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিনজন জজ যে ইনকোয়ারি (তদন্ত) কমিশনের কথা বলেছেন, অবিলম্বে সেই তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। এতে পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে।
৩. অফিসিয়াল গেজেট করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গেজেটে শাহাদাতবরণকারী সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।
৪. ২৫ ফেব্রুয়ারি শোক দিবসকে ঘিরে দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে।
৫. পিলখানা ট্রাজেডিকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৬. এ ঘটনাকে ঘিরে যেসব সেনা কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৭. নির্দোষ কোনো বিডিআর সদস্যকে যেন কোনোভাবেই সাজা দেয়া না হয়।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, ‘দুটো তদন্ত কমিটি হয়েছিল। বাহিনীর পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর। তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমরা চাই অন্তত তার তদন্ত কমিটির রিপোর্টটা পাবো। তাতে আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো। কারণ আমরা গণমাধ্যমে খুব কাটছাঁট অংশ জেনেছি। আমরা পুরোটাই দেখতে চাই।
‘এছাড়া উচ্চ আদালত যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছে, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে পর্দার আড়ালে যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা বেরিয়ে আসবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা চার্জ করতে পারবো।’