মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছিল সিলেটের সাংবাদিক এটিএম তুরাবের। বিয়ের কিছুদিন পর দেশ ছেড়ে চলে যান তার যুক্তরাজ্য প্রবাসী স্ত্রী তানিয়া ইসলাম।
কথা ছিল, তুরাবকেও সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করবেন তানিয়া, কিন্তু তা আর হলো না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে গত ১৯ জুলাই সিলেটে মিছিলে সংঘর্ষে প্রাণ হারান এটিএম তুরাব। তিনি দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পরিবারের অভিযোগ, সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তুরাব।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় তুরাবের মৃত মুখও তার প্রবাসী স্ত্রী দেখতে পারেননি বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান মো. আজরফ জানান, গত ১৩ মে বিয়ে করেন তুরাব। বিয়ের এক মাসের মাথায় তার স্ত্রী তানিয়া ইসলাম লন্ডন চলে যান। স্বামীর মৃত্যুর পর সেখানে তানিয়া মুষড়ে পড়েছেন।
আবুল আহসান জানান, তুরাবের মৃত্যুর খবর শুনে পরদিনই তানিয়া দেশে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফ্লাইটের টিকিট না পাওয়ায় আসতে পারেননি। এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় শেষবারের মতো স্বামীর মুখও দেখতে পারেননি তিনি।
তুরাবের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায়। ২০ জুলাই গ্রামের বাড়িতেই তার দাফন হয়।
এ সাংবাদিকের পরিবার নগরের যতরপুর এলাকায় থাকেন। ওই বাসাতেই থাকেন তুরাবের মা মমতাজ বেগম।
ছেলেকে এভাবে হারিয়ে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। বারবার বিলাপ করছেন ও মুর্ছা যাচ্ছেন এ নারী।
বাসায় কেউ গেলেই তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘পুলিশ কেন আমার ছেলেকে মারল?’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে গত ১৯ জুলাই দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকা থেকে মিছিল বের করে বিএনপি এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। আচমকাই সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় মিছিলকারীদের।
পুলিশ মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোড়ে। ওই দিন আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তুরাব। আচমকা সংঘর্ষ শুরু হলে তৎক্ষণাৎ নিজেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারেননি তিনি।
সংঘর্ষ শুরুর কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত সহকর্মীরা দেখেন তুরাব মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তৎক্ষণাৎ তাকে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান সহকর্মীরা।
পরে সেখান থেকে তাকে নগরের সোবহানীঘাট এলাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ইবনে সিনা হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থান তুরাবের মৃত্যু হয়।
পরের দিন ২০ জুলাই ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তুরাবের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শামসুল ইসলাম জানান, নিহতের শরীরে ৯৮টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায় ঢিলের আঘাতও ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
এদিকে তুরাব নিহত হওয়ার ঘটনায় গত বুধবার রাতে কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ করেন তার ভাই আবুল আহসান মো. আজরফ। এ অভিযোগে তুরাবের মৃত্যুর জন্য পুলিশকে দায়ী করা হয়।
অজ্ঞাতনামা আট থেকে ১০ জন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে তুরাবের ভাই অভিযোগ দিলে পুলিশ সেটি গ্রহণ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে নথিভুক্ত করেছে, তবে অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়নি।
যা ছিল লিখিত অভিযোগে
কোতোয়ালি থানায় করা লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৯ জুলাই বেলা একটা ৫৫ মিনিটে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকার কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান করছিলেন সাংবাদিক এ টি এম তুরাব। একপর্যায়ে বিএনপি মিছিল শুরু করলে তুরাব মিছিলের পেছনে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে অবস্থান নেন। মিছিলটি নগরের পুরান লেন গলির মুখে পৌঁছালে সশস্ত্র পুলিশ বিপরীত দিকে অবস্থান নেয়।
ওই সময় হঠাৎ লাগাতার গুলিবর্ষণের শব্দ শোনা যায়। এর একপর্যায়ে তুরাব গুলিবিদ্ধ হয়ে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন অন্য সহকর্মী ও পথচারীরা তাকে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় এবং তুরাবের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নগরের সোবহানীঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা ছয়টা ৪৪ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
এমন বাস্তবতায় পুলিশ বলছে, তুরাব কার গুলিতে নিহত হয়েছেন, সেটি নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
বাহিনীটির ভাষ্য, বন্দরবাজার এলাকায় সংঘর্ষে পুলিশের ওপর হামলা ও তুরাব নিহতের ঘটনায় ২০ জুলাই সিলেটের কোতোয়ালি থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। মামলায় এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন বলেন, ‘সাংবাদিক তুরাব নিহতের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আগেই একটি মামলা করা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলমান আছে। একই ঘটনায় দুটি মামলা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
‘এ জন্য পরিবারের করা অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একসঙ্গে তদন্ত করবেন।’