ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলে মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে রাজনীতি বন্ধের অঙ্গীকারনামায় প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষর নিচ্ছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
রোকেয়া হলে গতকাল রাত ১২টার দিকে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বের করে দেয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী হলের শিক্ষার্থীরা জানান, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শেষ করে রাত ৯টার দিকে হলে ঢুকে যান। আর রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকা বিনতে হোসাইনসহ বাকি ছাত্রলীগ নেত্রীরা রাত ১০টার পর হলে ঢোকেন। যদিও রাত ১০টার পর সাধারণত কোনো ছাত্রী হলে ঢুকতে পারেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যান আন্দোলনকারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ছাত্রলীগ নেত্রীরা হলে ঢুকলে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং হল ছেড়ে চলে যেতে বলেন। ওই সময় তারা যেতে না চাইলে শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া দেন। যদিও সেই সময় হলের হাউজ টিউটররা ছাত্রলীগ নেত্রীদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হল ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকা বিনতে হোসাইনসহ আরও আট নেত্রীকে সেই হল থেকে বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। বের করার সময় তাদের মারধর করতেও দেখা যায় কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে। পরে ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এরপর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নিলুফার পারভীনকে একটা কাগজে সই করতে চাপ দিতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে একপর্যায়ে সেই কাগজে স্বাক্ষর করেন প্রাধ্যক্ষ।
সেই কাগজে লিখা ছিল, ‘আমরা রোকেয়া হলের মেয়েরা আজ এই মর্মে লিখিত নিচ্ছি যে, আজ ১৭-০৩-২০২৪ তারিখ থেকে রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি (ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, যুবদল, জামাত-শিবির ইত্যাদি) নিষিদ্ধ করা হলো।’
এতে আরও বলা হয়, ‘হলে কোনো ধরনের পলিটিক্যাল রুম বা গণরুম থাকবে না। পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম হলে হবে না। কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা হলের সাথে থাকবে না।
‘আমরা হলের মেয়েরা যদি এইসব দলের দ্বারা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই, তাহলে এই দায় প্রশাসন ও হল প্রভেস্টকে নিতে হবে। আজ থেকে রোকেয়া হলকে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত ঘোষণা করা হলো।’
এদিকে রোকেয়া হলের এ প্রতিবাদের খবর ছাত্রীদের বাকি হলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর একে একে তারাও হল ছাত্রলীগের নেত্রীদের বের করে দিয়ে প্রাধ্যক্ষদের কাছ থেকে হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন।
কিছু হলে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বের হতে সকাল পর্যন্ত সময় দিলেও এর আগেই তারা বের হয়ে যান।
রাত ১০টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরাও হল প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন।
আন্দোলন শেষে ফিরে জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান নেন। এ খবরে হলেই আর প্রবেশ করেননি ছাত্রলীগ নেতারা। রাত দেড়টা থেকে হলজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ওই সময় হলের ছাত্ররা কোটা আন্দোলনের পক্ষে একটি মিছিল নিয়ে হলের টিনশেড থেকে প্রধান ভবন হয়ে বর্ধিত ভবনের (এক্সটেনশন বিল্ডিং) দিকে যায়। ওই সময় হলে থাকা ছাত্রলীগের কয়েকজন পদপ্রত্যাশী দ্রুত হল ছাড়েন।
মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘আমার ভাই কবরে, প্রশাসন নীরব কেন’, ‘জহু হলে পুলিশ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগান দেন। পাশাপাশি হলের ফটকে থাকা ছাত্রলীগের ব্যানার ও ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলেন তারা। এরপর হলের রাস্তায় এগুলো দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।
এ খবর পেয়ে রাত আড়াইটার দিকে টিএসসি থেকে ছাত্রলীগের বহিরাগত নেতা-কর্মীরা জহুরুল হলের দিকে লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে যান। খবরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালকে জানানো হলে তিনি এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটতে দিবেন না জানান। পরে দেখা যায়, বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভিসি চত্বর থেকে টিএসির দিকে ফিরে যান।
গতকাল রাত সাড়ে তিনটার দিকে হলের ফটকের সামনে জড়ো হয় পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতিতে উত্তেজনা বাড়ে হলের মধ্যে। এ সময় শিক্ষার্থীরা পুলিশকে দুয়োধ্বনি দিতে থাকেন।
শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে হলের আবাসিক শিক্ষকরা ফটকের সামনে যান। কিছুক্ষণ পরে ফেরত এসে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন এবং শান্ত থাকার পরামর্শ দেন।
শিক্ষার্থীরা হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত থাকলে হল থেকে বহিষ্কার এবং কোটা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সময়ে হলে সার্বিক নিরাপত্তা ও বহিরাগত বের করার জন্য হল প্রশাসনের কাছে একটি লিখিত প্রতিশ্রুতি চান এবং হল প্রশাসন শিক্ষার্থীদের এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষর করে।
এর একটু পরে হলের বাইরে থেকে বাইক নিয়ে এসে হল গেটের সামনে ককটেল ফোটানো হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি, হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাকিবুর রহমান সায়েম এবং রাব্বি হকসহ আরও কয়েকজন এই ঘটনা ঘটিয়েছেন এবং শিক্ষার্থীরা সচক্ষে তাদের দেখেছেন।
এই ঘটনায় শিক্ষার্থীরাও আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এরপর তারা ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষে গিয়ে তাদের খোঁজা শুরু করেন এবং কিছু কিছু কক্ষ ভাঙচুরও করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলেও মধ্যরাতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হল প্রাঙ্গণে নেমে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। এ সময় ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকে হলে অবস্থান করতে দেখা গেলেও হল ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা রাতেই হল ত্যাগ করেন। পরে শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষের কাছে গিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কারণে কোনো হয়রানি না করার নিশ্চয়তা চান। হল প্রাধ্যক্ষ আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা কক্ষে ফিরে আসেন।
রাতে কোনো ঘটনা না ঘটলেও সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে। তারা শিক্ষার্থীদের জড়ো করে ‘আমার ভাই মরল কেন প্রশাসন জবাব চাই’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘টোকাই দিয়ে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’ স্লোগান দেন।
ওই সময় সেখানে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. বিল্লাল হোসেন এবং কয়েকজন হাউস টিউটর শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেন হল প্রাধ্যক্ষ। তারা তাদের বিভিন্ন দাবি তৈরি করার জন্য সময় চান।
পরে শিক্ষার্থীরা হলের মুক্ত মঞ্চে বসে শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে পাঁচটি দাবি তৈরি করেন। তাদের উল্লেখযোগ্য দাবি হলো হলের সব ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে; গত পরশু ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করে হল থেকে বের করে দিতে হবে।
এরপর শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে হল প্রাধ্যক্ষের কক্ষে যান।
এদিকে সকাল সাতটা থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তারা হলে অবস্থানরত ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ছাড়তে বাধ্য করেন।
ওই সময় হল ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা, হল ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী সবাই হল ছেড়ে বের হয়ে আসেন।
এরপর শিক্ষার্থীরা তাদের সবার কক্ষের সব জিনিসপত্র ভাঙচুর করে বাইরে ফেলে দেন। এ প্রতিবেদন লেখা অবস্থায়ও শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর করছিলেন।
সকাল সাড়ে আটটা থেকে জসীম উদ্দীন হল ও মাস্টার দা সূর্যসেন হলেও শিক্ষার্থীরা হল দখলে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দেন এবং তাদের কক্ষ ভাঙচুর করে সব কাপড় বাইরে ফেলে দিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন। বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগ নেতারা ঘটনা আঁচ করতে পেরে নিজ থেকে বের হয়ে যান।
জসীম উদ্দীন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের কক্ষ, বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের কক্ষ এবং সূর্যসেন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবীরের কক্ষেও ভাঙচুর চালিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এসব হলে শিক্ষার্থীরা দখলে নিয়ে আছেন আর ছাত্রলীগ নেতারা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছেন।
এ প্রতিবেদন লেখা অবস্থায় ভাঙচুর করা হচ্ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকা ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষগুলো।