বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চিনি চোরাচালানের ‘নিরাপদ রুট’ সিলেট

  •    
  • ১২ জুলাই, ২০২৪ ১৫:৩০

প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা শত শত বস্তা চিনি জব্দ করা হচ্ছে।

ভারত থেকে চিনি চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে সিলেট। জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই আসছে শত শত বস্তা চিনি।

সম্প্রতি পুলিশের তৎপরতায় চোরাই চিনির বড় কিছু চালান আটক হলেও চোরাচালান থামছে না।

অভিযোগ রয়েছে, চিনি চোরাচালানের সঙ্গে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা-কর্মী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজনেরও যোগসাজশ রয়েছে। এ কারণে বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান।

সিলেট থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে ছয়টি ট্রাকভর্তি এক লাখ ২০ হাজার কেজি ভারতীয় চোরাই চিনি জব্দ করে পুলিশ, যার মূল্য প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা বলে জানিয়েছে বাহিনীটি।

গতকাল ভোরে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) শাহপরাণ ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব চিনি জব্দ করা হয়।

এভাবে প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা বিপুল পরিমাণ চিনি জব্দ করা হচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, যে পরিমাণ চিনি জব্দ করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি চিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে। জেলার জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এবং বিয়ানীবাজার উপজেলার সীমান্তের শতাধিক স্থান দিয়ে চিনি দেশে প্রবেশ করেছে।

অবৈধভাবে আসা এসব চিনিতে এখন ছেয়ে গেছে সিলেটের বাজার। এতে সিলেটে চিনির দামও কিছুটা কমেছে, তবে সংকটে সৃষ্টি হয়েছে দেশীয় চিনি শিল্পে।

স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, চোরকারবারিরা দিনমজুরদের মাধ্যমে ভারত থেকে বিভিন্ন চোরাইপথে বাংলাদেশে চিনির বস্তা নিয়ে আসেন। এ জন্য দিনমজুরদের বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেও মাসোহারা দেয়া হয়। দেশে প্রবেশের পর এসব চিনি ট্রাকে করে নগরে নিয়ে আসা হয়। এ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগসহ সরকারদলীয় কিছু নেতা। এ নেতারা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে নিয়ে আসা চিনির ট্রাক পাহারা দিয়ে নগরের বৃহৎ পাইকারি বাজার কালিঘাটে নিয়ে আসেন। ট্রাকের সামনে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে পাহারা দেয়ায় এসব ট্রাক পুলিশও আটকায় না। চোরাচালানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ চোরাই চিনি চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাডভোকেট প্রবাল চৌধুরী পুজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট দিলে চোরাচালানের বিষয় জনসমক্ষে আসে। এরপর অভিযুক্তরা হামলা চালিয়ে তাকে আহত করেন।

হামলার ঘটনায় পুজন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, মহানগর সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের ৫৫ নেতা-কর্মীর নামে মামলা করেন।

চিনি চোরাচালানে সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ।

গত ২৪ জুন সিলেট সার্কিট হাউসে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মতবিনিময় সভায় মাসুক উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেক কথা সিলেট শহরে শুনি। সিলেট শহরে হাঁটতে পারি না। ছাত্রলীগ আমাদের ছোট ভাই। আমরাও ছাত্রলীগ করেছি। আমরা ছাত্রলীগ করে দীর্ঘ বছর ধরে রাজনীতি করছি।

‘সুতরাং আমরা কখনও কোনো বদনামের বোঝা নিয়ে চলিনি। ছাত্রলীগ থেকে আজকে আওয়ামী লীগের এই পর্যায়ে এসেছি।’

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় নিলামে কেনা চিনি ৮ জুন ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ১৪ জুন বিয়ানীবাজার উপজেলা ও বিয়ানীবাজার পৌর শাখার কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরে ওই ঘটনায় মামলা করার পর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পৌর শাখার সভাপতিকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।

এ ছাড়া নিজ দলের মধ্যে বিভক্তির জেরে পাল্টাপাল্টি হামলাসহ নানা অভিযোগ ওঠে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগকে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে অভিযোগ করে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিচ্ছে, কিন্তু এমনভাবে কথা হচ্ছে যেন ছাত্রলীগের সবাই চোরাকারবারি। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতেই এমন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’

গতকাল প্রায় দেড় কোটি টাকার চিনি জব্দ প্রসঙ্গে এসএমপি ডিবির উপকমিশনার তাহিয়াত আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘ভোর পাঁচটার দিকে শাহপরাণ থানাধীন সুরমা বাইপাস দিয়ে আসা পাঁচটি ট্রাক শাহপরাণ ব্রিজ এলাকা থেকে আটক করা হয়। এ সময় বহরের পেছনের একটি ট্রাক পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা শাহপরাণ থানা পুলিশকে অবগত করলে শাহপরাণ (রহ.) মাজার তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশের সহায়তায় আমরা মাজার এলাকা থেকে সেই ট্রাক আটক করি।

‘এই ছয়টি ট্রাক থেকে মোট এক লাখ ২০ হাজার কেজি ভারতীয় চোরাই চিনি জব্দ করা হয়েছে, যার মূল্য এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এই অভিযানে মোট সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের নাম পরবর্তী সময়ে জানানো হবে।’

সম্প্রতি এভাবে চোরাই চিনির কয়েকটি বড় চালান জব্দ করেছে পুলিশ। গত ৬ জুন সিলেটের জালালাবাদ থানাধীন হাটখোলা ইউনিয়নের উমাইরগাঁওয়ের ভাদেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়ক থেকে পুলিশ ১৪টি ট্রাকে ভর্তি দুই হাজার ১১৪ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়। প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা মূল্যের চিনির ওই চালানের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজন আটক করা হয়েছে।

এভাবে গত কয়েক মাসে সিলেটে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার চোরাই চিনি জব্দ করে প্রশাসন, তবে চোরাই চিনি জব্দ এবং কিছু ক্ষেত্রে চিনির বাহককে আটক করা হলেও হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সিলেট সীমান্ত দিয়ে চোরাই পণ্য প্রবেশ আরও বেড়েছে।

এমনকি বন্যার মাঝেও থেমে নেই চিনি চোরাচালান। সীমান্ত এলাকা থেকে জলমগ্ন রাস্তা ও নৌপথে চোরাকারবারিরা চিনি নিয়ে আসছে মহাসড়কে। সেখানে বড় ট্রাক, পিকআপ এমনকি মোটরসাইকেলে করেও নিয়ে আসা হয় সিলেট শহরে। শহরের বিভিন্ন গুদামে রেখে ভারতীয় সিলযুক্ত বস্তা পরিবর্তন করে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিলেট জেলা পুলিশ ও সিলেট মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় চোরাই চিনি চোরাচালানের ঘটনায় ৬১টি মামলা করা হয়েছে। এতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪৭ জনকে।

এসবের মধ্যে জৈন্তাপুর থানার একটি মামলার আসামি মনসুর আহমদ নিজপাট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার শ্যালক আবদুল কাদিরও এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার জাকির হোসেন খান বলেন, ‘চোরাই পণ্য ঠেকাতে মহানগর এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ। চোরাই পণ্য জব্দ করার সময় ধৃতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা দায়ের করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে চার্জশিভুক্ত আসামিও করা হয় তাদের। এ ছাড়া তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অন্য কারবারিদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে পুলিশ।’

এ বিভাগের আরো খবর