কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে কড়া নজরদারি। সীমান্ত এলাকায় কড়া পাহারা বসিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এতোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরও মিয়ানমারে জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গারা আবার অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে বিজিবি ও কোস্টগার্ড কার্যত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকাতে পারছে না।
বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তাদের দাবি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা সামান্যই। রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক নৌকাকে অনুপ্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে এবং অনেক রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতের বেলায় কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।
শাহপরীর দ্বীপ বিওপির কোম্পানি কমান্ডার আব্দুর রহমান বাহার এমনটা দাবি করলেও বস্তুত মঙ্গলবার রাতেও ২০ জনের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এখন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
অনুপ্রবেশকারী মোশাররফ, এরশাদ, রাজু আক্তার, মরিয়ম বেগম, সমজিদা, রফিক, মকবুল হোসেন, জিয়া উদ্দিনসহ আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মগদের সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়েছে।
আরাকান আর্মি গ্রামে প্রবেশ করে এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে গ্রামটি খালি করতে বলে। গ্রাম না ছাড়লে সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। আবার তাদের সঙ্গে যুক্ত না হলে পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রাণের ভয়ে তারা গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ওপারে সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় তাদের মতো আরও অনেকে এপারে চলে আসার পথ খুঁজছে।
অনুপ্রবেশকারী মোশাররফ জানান, মংডুর নলবাইন্যা ও মেরোংলা এলাকায় সোমবার তাণ্ডব চালিয়ে আরাকান আর্মি ২০টি ঘরে আগুন দিয়েছে। এ সময় তাদের গুলিতে ১০ জন রোহিঙ্গা গুরুতর আহত হয়েছে। অনেকে মারাও গেছে। প্রাণে বাঁচাতে তারা নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
জান্তা বাহিনী আগে এসব এলাকায় তাণ্ডব করেনি। এখন মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি বেশি নির্যাতন করছে আরাকান আর্মি। তাদের দলে যোগ না দিলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। নইলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলছে।
আরেক অনুপ্রবেশকারী এরশাদ বলেন, ‘আরাকান আর্মি ১৫টি গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের মদদ দিচ্ছে বলে নাটক করছে। তারা এখন রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে নতুন নতুন এলাকা বেছে নিচ্ছে।
‘ওদিকে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের এলাকায় এসে যুদ্ধ শুরু করলে তখন আমাদের গ্রামকে লক্ষ্য করে মিয়ানমার বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এতে আমরা দুই পক্ষ থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নারী-শিশু ও বৃদ্ধ নিহত হচ্ছে।’
রাজু আক্তার নামের এক নারী বলেন, মংডু সুএজাতে আমাদের গ্রামে মগবাগি ঢুকে আছে। আমরা বেশি কষ্টে ছিলাম। আমাদের নির্যাতন করতেছে। আমরা ঘরবাড়ি ফেলে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
‘আমাদের এলাকার দুজন তাদের বাড়িঘর দেখতে গেছিল। আরাকান আর্মি তাদের গলা কেটে হত্যা করেছে। আমরা আসার আগেও হত্যা করছে তিনজনকে। তাই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে চুরি করে চলে আসি। পথে আমার স্বামীকে গুলি করে আরাকান বাহিনী। টাকা ও গয়না যা ছিল সব লুট করে নিয়েছে তারা।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমান্তে বিজিবি ব্যাটালিয়নের সীমান্ত চৌকি আছে এক থেকে দুই কিলোমিটার পর পর। চৌকিগুলোতে বিজিবি সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে পাহারা দিচ্ছেন। কিন্তু এক চৌকি থেকে অন্য চৌকি দেখা যায় না। আঁকাবাঁকা নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা কিছু সড়ক অংশ কিংবা উপকূলীয় প্যারাবন থাকায় দৃষ্টিসীমা খুব বেশি দূরে যায় না। এ কারণে কোথায় কোন সময় রোহিঙ্গাদের নৌকা ভিড়ছে তা বিজিবি সদস্যরা সহজে বুঝতে পারেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার কল করলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কোস্টগার্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সবসময় চেষ্টা আছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। অনেক রোহিঙ্গা পুশব্যাক করা হয়েছে ইতোমধ্যে।’
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তে কঠোর নজরদারি রেখেছে। তারপরও ফাঁকফোকর দিয়ে দালালের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। সেসব দালালকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক জানান, টেকনাফ উপজেলার সঙ্গে নদীপথে মিয়ানমারের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান থাকলেও অসংখ্য ফাঁকফোকর থাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সহজেই অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। তাই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের টহল আরও জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি সীমান্তে সক্রিয় দালালগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে তিন হাজার ৩৫৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে তাদের মিয়ানমারে (স্বদেশে) ফেরত পাঠায় বিজিবি। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন নারী, ৭৪৯টি শিশু ও ১৭৫৭ জন পুরুষ। আর তিন রোহিঙ্গাকে থানা পুলিশে দেয়া হয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন চালায়। সে সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। আগে আসা রোহিঙ্গাসহ ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ঠাঁই হয় উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।