১৭ জুন সকাল। সবাই মেতেছে ঈদের আনন্দে। আর লিলু বেগম ব্যস্ত ঘরের আসবাবপত্র নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরে। কেননা ওই ঈদের দিন ভোরেই পানি ঢুকে যায় তার ঘরে। এরপর প্রায় এক মাস পেরুতে চললেও এখনও পানি নামেনি তার ঘর থেকে।
সিলেট নগরের ৪০ নম্বরের ওয়ার্ডের মনিপুর এলাকার বাসিন্দা লিলু বেগমের মতো এখানকার অনেক পরিবারকেই দীর্ঘদিন ধরে পানিবন্দি অবস্থার যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। কেননা বন্যায় পুরো ওয়ার্ডই বলতে গেলে পানির নিচে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
লিলু বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘পানিতে থাকতে থাকতে হাত-পা পচে যাচ্ছে। ঘরের মাটির দেয়াল ভেঙে পড়ছে। তবু পানি নামছে না। আগেও বিভিন্ন সময় বাড়িতে পানি উঠেছে। কিন্তু এতো দীর্ঘ সময় কখনও থাকেনি।
‘অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন মনে হচ্ছে আর কোনদিনই বুঝি পানি নামবে না। মাছের মতো সারাজীবন পানিতে ভেসে থাকতে হবে।’
বন্যায় ১৪ জুন থেকেই সিলেট নগরীর ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে যেতে শুরু করে। সেই বন্যার পানি কমার আগেই ১ জুলাই আবার বন্যা শুরু হয়। ফলে প্রায় এক মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে আছেন এই ওয়ার্ডের মনিপুর, আলমপুর, ছিটা গোটাটিকর এলাকার বাসিন্দারা। দীর্ঘ সময় ধরে পানিবন্দি অবস্থায় থাকায় দুর্ভোগের অন্ত নেই তাদের।
নগরের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থান দক্ষিণ সুরমা উপজেলায়। এই উপজেলার অবস্থান কুশিয়ারা নদী অববাহিকায়। এবারের বন্যায় কুশিয়ারা তীরের বাসিন্দারাই পড়েছেন বেশি দুর্ভোগে।
সিলেটের প্রধান নদী সুরমার পানি কমে এর তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কুশিয়ারার পানি কিছুতেই কমছে না। বরং সুরমার পানি কমার সময়েও কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে। প্রায় এক মাস ধরে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার উপরে অবস্থান করছে। ফলে কুশিয়ারা তীরবর্তী জনপদ জকিগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, দক্ষিণ সুরমা, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের বাসিন্দারা দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে পড়েছেন।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, মঙ্গলবার সকালে কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শেওলা এবং অবশলীদ পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার উপরে রয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে কুশিয়ারা নদীর পানি না কমা প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘হাকালুকি হাওর-তীরবর্তী মৌলভীবাজারের জুড়ী, বড়লেখা ও কুলাউড়া উপাজেলার পানিও কুশিয়ারায় এসে নামে। ফলে কুশিয়ারা নদীর পানি কমার গতি খুবই ধীর। আর এ বছর একবারের বন্যার পানি কমার আগেই আরেকবার বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে কুশিয়ারা তীরবর্তী বাসিন্দারা দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগে পড়েছেন।
কুশিয়ারার পানি না কমায় সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দারা। গত বন্যায় পানিবন্দি থাকা অবস্থায়ই ফের বন্যাকবলিত হয় ফেঞ্চুগঞ্জ। উপজেলা সদর, হাসপাতাল ও রাস্তাঘাটে এখনও পানি থৈ থৈ করছে। এ উপজেলার বাসিন্দারা এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে দিনযাপন করছেন।
জকিগঞ্জ উপজেলায়ও একই অবস্থা। কুশিয়ারার ডাইক ভেঙে এখনও এই দুই উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিয়ানীবাজার উপজেলায়ও চলতি সপ্তাহে কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করেছে। উপজেলার দেউলগ্রাম, গোবিন্দশ্রী, আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর, আলীনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে।
জকিগঞ্জ পৌর এলাকার নরসিংহপুর, উপজেলার ছারিয়া, রারাই এলাকার তিনটি ডাইক ভেঙে এ যাবত উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ৮৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে লাখের ওপর মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছেন বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় এখনও পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এর মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন নয় হাজার ৬৩৫ জন।
ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রায় এক মাস ধরে বাজারের সব দোকানে পানি। দোকান খোলা রাখলেও কোনো ব্যবসাপাতি হচ্ছে না। আর বাজারের সড়ক দিয়ে তো নৌকা চলাচল করছে।’
ঈদের পরদিন প্রথম দফা বন্যার পর জান আলী শাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের ছিটা গোটাটিকর এলাকার বাসিন্দা মনিরাম বিশ্বাস। এরপর আর বাড়ি ফিরতে পারেননি তিনি।
মনিরাম বলেন, ‘এক মাস ধরে একেবারে মানবেতর জীবনযাপন করছি। ঘর থেকে একবার পানি নামে তো দুদিন পর বৃষ্টিতে আবার পানি ঢুকে যায়। রাস্তাঘাটও পানির নিচে। ফলে বাড়ি ফিরতে পারছি না।
‘সিটি করপোরেশনের মধ্যে থেকেও আমরা সব ধরনের নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত। আমাদের এলাকার সড়ক ভাঙ্গাচোরা, কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।’
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, ‘নগরের কয়েকটি ওয়ার্ডে এখনও বন্যার পানি রয়ে গেছে। বিশেষত নতুন ওয়ার্ডগুলোর বাসিন্দারা বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন। এসব ওয়ার্ডের উন্নয়নে একটি মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া পানি নামার পর দ্রুততার সঙ্গে কিছু সংস্কার কাজ করা হবে।’
বন্যার মধ্যেই এইচএসসি পরীক্ষা
বন্যার মধ্যেই সিলেটে মঙ্গলবার শুরু হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। অথচ বন্যার কারণে এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে কয়েকটি কলেজ। অবশ্য শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, পানি থাকা কেন্দ্রগুলোর পরীক্ষার্থীদের অন্য কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এখনও পানি রয়েছে সিলেটের দক্ষিণ সরকারি ডিগ্রি কলেজে। বন্যার পানিতে কলেজের রাস্তা ও আঙিনা ডুবে আছে। এই কলেজে মঙ্গলবার থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের প্রবেশের সুবিধার্থে রাস্তায় ফেলা হয়েছে বালুর বস্তা। সেই বস্তার ওপর দিয়ে মঙ্গলবার সকালে কলেজে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। একইভাবে বোর্ডের অনেক কেন্দ্রে বন্যার পানি মাড়িয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন পরীক্ষার্থীরা।
দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেন, ‘কলেজের প্রবেশ পথে পানি থাকলেও পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে রাস্তায় বালুর বস্তা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি শ্রেণিকক্ষে পানি রয়েছে। তবে সেগুলোতে পরীক্ষার হল রাখা হচ্ছে না।’
এছাড়া বালাগঞ্জ ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্র থাকলেও সেখানে পানি থাকায় এ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা বালাগঞ্জ সরকারি কলেজে পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অরুণ চন্দ্র পাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়াতে কেন্দ্রের আশপাশে কোনো পানি নেই। এটা বিবেচনা করেই মঙ্গলবার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু করা হয়েছে।’
জানা গেছে, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পুরো বিভাগের ৩০৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮২ হাজার ৭৯৫ পরীক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় বসেছেন।