কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ছয় দিনব্যাপী বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার বন্যাপ্লাবিত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার দুটি পৌরসভাসহ প্রায় ৬০টি ইউনিয়নের দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিকভাবে মানুষ যেসব উঁচু স্থানে গবাদিপশু রেখেছে, গত দুদিনে সেসবও স্থানও তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে পানিবন্দি মানুষ। জীবন বাঁচাতে অনেকে নিজস্ব নৌকায়, উঁচু রাস্তা, ফ্লাড শেল্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উঁচু ভূমিতে কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
গবাদি পশু নিয়ে বানভাসিরা আরও বেশি বিপাকে পড়েছেন। ছবি: নিউজবাংলা
গত পাঁচদিন ধরে নৌকায় স্ত্রী, ছেলে ও দুই নাতিকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের গুজিমারী গ্রামের শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘ঘরের আসবাবপত্র, চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় ও মূল্যবান জিনিসপত্র যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য নৌকায় আশ্রয় নিয়েছি। সারাদিন বৃষ্টির কারণে কিছু রান্নাবান্নাও করতে পারছি না। খুব সমস্যায় আছি।’
একই উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর বাগুয়ার মনসুর আলী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজখবর নিতে আসে নাই। চুলা বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুপুর গড়িয়ে গেলেও পেটে কিছু পড়েনি।’
একই উপজেলার হকের চরের মতিউর বলেন, ‘ছোট মেয়েডা অসুস্থ। কোনো ডাক্তার পাইতাছি না। ঝাড়-ফুঁক দিয়া রইছে।’
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কালির আলগা গ্রামের ছমিরণ বলেন, ‘খোলা নৌকায় গাদাগাদি কইরা আছি। সরকারিভাবে চাল-ডাল-তেল পাইলেও লাকড়ির অভাবে আন্দোন-বান্দোন করবার পারতাছি না। পোলাপান খুব কান্নাকাটি করতাছে।’
এদিকে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে দুধকুমার নদীর বেড়ি বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে নতুন করে আরও প্রায় ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া এলাকার পুরাতন বেড়ি বাঁধটির দুটি স্থানে প্রায় ১শ মিটার এলাকা ভেঙে যায়। ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে একের পর এক গ্রাম প্লাবিত হতে থাকে। পানি আরও বৃদ্ধি পেলে নাগেশ্বরী পৌর শহর নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। বাঁধ ভাঙায় ইতোমধ্যে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া, মালিয়ানি, সেনপাড়া, তেলিয়ানী, পাটেশ্বরী, বোয়ালেরডারা, অন্তাইপাড়, ধনিটারী, বিধবাটারী, বড়মানী, বামনডাঙ্গা, নাগেশ্বরী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাঞ্জুয়ার ভিটা, ভুষিটারী, ফকিরটারী গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রনি জানান, শুক্রবার রাত থেকে তার ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড বন্যাকবলিত হয়েছে। সকালে মিয়াপাড়া বেড়ি বাঁধের দুটি স্থানে ভেঙে যায়। এতে বেশকিছু গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। আরও কয়েকটি বাঁধ আছে। সেগুলোও ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। দ্রুত সেগুলো মেরামত করা প্রয়োজন।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিব্বির আহমেদ বলেন, ‘বাঁধ ভাঙার বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জেনেছি। সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।’
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, দুধকুমার নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ চলমান। সেগুলো বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙার কোনো খবর তাদের কাছে নেই।
কুড়িগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ে ৮৩টি মেডিক্যাল টিম বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে।
তবে কার্যত বন্যাকবলিত এলাকায় এরকম কোনো টিমের কাউকে দেখা যায়নি। ওইসব গ্রামে পাঁচদিন ধরে কোনো মেডিক্যাল টিম খোঁজখবর নেয়নি বলে বানভাসীরা জানিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৬০ হেক্টর ফসলি জমি, বীজতলা ও শাকসবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষতির হিসেব পাওয়া যাবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নবেজ উদ্দিন সরকার জানান, ২৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানান, চলমান বন্যায় ১০৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৭১টি স্কুল, ৩২টি মাদরাসা ও ৬টি কলেজ রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের নজরে দেয়া হলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেব। আমরা মিলিতভাবে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর।’