কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় এক ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তথা এসি ল্যান্ডের নাম ভাঙিয়ে প্রতি ফাইলে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে।
এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
একজনের জমি অন্যজনের নামে এবং একই জমি দুইবারে দুজনের নামে খারিজ দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভূমি কর্মকর্তা।
এমন বাস্তবতায় কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) বলেছেন, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযুক্ত ভূমি কর্মকর্তার নাম হবি আহমেদ বুলবুল। তিনি পাকুন্দিয়া উপজেলার নারান্দী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কর্মরত।
নারান্দী ইউনিয়নের পোড়াবাড়িয়া গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী আলাউদ্দিন বলেন, ‘১৯৯৭ সালে মায়ের কাছ থেকে ছয় শতাংশ বসতবাড়িসহ ৫০ শতাংশ জমি কিনি। এর আগে এ বসতবাড়িতে আমার মা-বাবা বসবাস করতেন (আলাউদ্দিন তাদের পালিত সন্তান)। আমিও বিগত ৬০ বছর যাবত বসবাস করছি।
‘কিছুদিন পূর্বে হঠাৎ জানতে পারি, সারা জীবন বসবাস করা বাড়িটিসহ ৫০ শতাংশ জায়গা আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। মাঠপর্চার বলে সেটি খারিজ হয়ে গেছে শাহজাহান মিয়ার নামে।’
তিনি বলেন, ‘খবর পেয়ে আমার যাবতীয় দলিলাদিসহ ভূমি অফিসের কর্মকর্তা হবি আহমেদ বুলবুলের কাছে গেলে তিনি জানান, এটা সংশোধন করে দিলে ভূমি অফিসের সকল কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করতে হবে। এ জন্য তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে।’
আলাউদ্দিনের অভিযোগ, ঘুষের টাকা দিতে না পারায় বসতবাড়িসহ জমির খারিজ করতে পারেননি তিনি। পরে এ বিষয়ে ভূমি কর্মকর্তা হবি আহমেদ বুলবুলের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। তার পরও প্রতিকার মেলেনি।
আলাউদ্দিনের প্রতিবেশী আফাজ উদ্দিন (৬৫) জানান, জন্মের পর থেকে তিনি দেখে আসছেন এ বাড়িতে আলাউদ্দিন বসবাস করেন। এখন হঠাৎ শুনলেন মাঠপর্চার বলে এ বাড়িটি নাকি আরেকজনের নামে খারিজ হয়ে গেছে। বিষয়টি তার কাছে খুব খারাপ লাগছে।
জমিটি যার নামে খারিজ করা হয়েছে, তার নাম মো. শাহজাহান। তিনিও একই গ্রামের বাসিন্দা। তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে কথা হয় শাহজাহানের বড় ছেলে কাজল মিয়ার সঙ্গে। তার দাবি, তারাও পৈত্রিক সূত্রে ওই জায়গার মালিক। আলাউদ্দিনের পালিত মা তার অংশের চেয়ে বেশি জায়গার দলিল দিয়েছেন। যে পরিমাণ জায়গা তিনি বিক্রি করেছেন, সেখানে তাদেরও অংশ রয়েছে। মাঠপর্চার বলে এসি ল্যান্ড তাদের খারিজ দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
শ্রীরামদী গ্রামের বাসিন্দা আমির উদ্দিন জানান, শ্রীরামদী মৌজায় পৈত্রিক সূত্রে দুটি দাগে তিনি ১৮ শতাংশ জমি পান। জায়গাটি অধিগ্রহণ হওয়ায় ২০২৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নিজ নামে খারিজ করেন তিনি। এর আগে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর একই জায়গা খারিজ করা হয়েছিল তার চাচা মোমতাজ উদ্দিনের নামে। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩ জুলাই সেখান থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ জমি খারিজ দেয়া হয়েছে তাদের প্রতিবেশী মো. ফেরদৌস ও রাবেয়া তাপসী নামে দুজনকে।
আমির উদ্দিনের প্রশ্ন, ‘আমার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে অন্যদের নামে খারিজ দেওয়া হলো কীভাবে? তা ছাড়া একই জায়গা থেকে আমার প্রতিবেশী ফেরদৌস ও রাবেয়াকে যেহেতু সাড়ে ৭ শতাংশ খারিজ দেয়া হয়েছে তাহলে তাকে পুনরায় ১৮ শতাংশের খারিজ দেয়া হলো কেন?’
আমির উদ্দিন বলেন, ‘নারান্দী ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা হবি আহমেদ বুলবুল একই জায়গায় দুইজনের নামে খারিজ দিয়েছেন। যেখানে মোট জায়গার পরিমাণ ১৮ শতাংশ, সেখানে খারিজ দিয়েছেন সাড়ে ২৫ শতাংশের।’
এ ব্যাপারে নারান্দী ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা হবি আহমেদ বুলবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এ কর্মকর্তার দাবি, তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি কারও কাছে ঘুষ চাননি।
যদিও এসি ল্যান্ডের নাম ভাঙিয়ে বুলবুলের ঘুষ দাবির একটি ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, একটি খারিজ সংক্রান্ত বিষয়ে একজনের কাছে ঘুষ দাবি করে বুলবুল বলছেন, অধিগ্রহণের একটি ফাইল খারিজ করতে গেলে এসি ল্যান্ডকেই দিতে হবে ২০ হাজার টাকা।
ভিডিওটি তাকে দেখিয়ে জানতে চাইলে নিজের বলে স্বীকার করলেও ঘুষ দাবির বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
এ বিষয়ে পাকুন্দিয়া উপজেলার সাবেক এসি ল্যান্ড তানিয়া আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি পাকুন্দিয়া থেকে বদলি হয়ে চলে এসেছি। সেখানকার কোনো কিছু জানার থাকলে বর্তমান ভূমি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে হবে।’
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বিষয়ে সরাসরি কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তবে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, ‘ভূমি কেন, কোনো পর্যায়ের দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেয়া হবে না। আর ভূমিতে তো প্রশ্নই ওঠে না।’
ডিসি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনই অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু পরে যাচাই করে দেখা যায় নিজেরা পারিবারিকভাবে রেষারেষি করে ভূমি সংক্রান্ত এসব অভিযোগ করে থাকেন।’