কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ইজিবাইক চালককে হত্যা মামলায় চারজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত।
এ ছাড়াও তাদের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক বুধবার বিকেলে আসামিদের উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন ভৈরব উপজেলার ছনছড়া গ্রামের মো. লিটন মিয়া, একই গ্রামের মো. রব্বানী, ভাটি কৃষ্ণনগর গ্রামের জুয়েল মিয়া ও বাঁশগাড়ী গ্রামের মো. কাজল।
প্রাণ হারানো ইজিবাইক চালক সোহেল ওরফে বদন খন্দকার ছিলেন কুলিয়ারচর উপজেলার মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম খন্দকারের ছেলে।
কিশোরগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আবু নাসের ফারুক মো. সনজু এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বের হন ইজিবাইকচালক সোহেল ওরফে বদন খন্দকার। দুপুরে রিকশাটি দাড়িয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ডে রেখে বাড়িতে খেতে আসেন তিনি। দুপুর আড়াইটার দিকে আবার দাড়িয়াকান্দি থেকে চার যাত্রী নিয়ে ডোমরাকান্দা বাজারের উদ্দেশে যান তিনি। পরে আর আর বাড়ি ফেরেননি সোহেল।
ওই দিন রাত ৯টার দিকে তার মোবাইলে কল দেন স্ত্রী সরুফা বেগম, কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। পরে রাতভর পরিবারের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাননি।
পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে লোকমুখে সংবাদ পান ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ এলাকার ফারুক চেয়ারম্যানের বাড়ির ২০০ গজ দক্ষিণে একটি অজ্ঞাত মরদেহ পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে বদন খন্দকারের মরদেহটি শনাক্ত করে পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সোহেল ওরফে বদন খন্দকারের বাবা আবদুল হান্নান খন্দকার বাদী হয়ে ভৈরব থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন।
পরে পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. জামিল হোসেন জিয়া মামলাটি তদন্ত করে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত রায় ঘোষণা করেন।
যেভাবে সনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয় আসামিদের
মামলার পর তদন্তের ধারাবাহিকতায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নিহতের ব্যবহৃত ফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে সেই মোবাইল ফোনের সূত্র ধরেই অজ্ঞাতনামা আসামিদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সন্দেহভাজন আসামি লিটন মিয়াকে (২৫) ভৈরবের শম্ভুপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে ওই আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামি রব্বানীকে (২৫) ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভৈরবের শিমুলকান্দি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর অপর দুই আসামি কাজল (৩৪) ও জুয়েল মিয়াকে (২৪) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আসামি লিটন, কাজল, জুয়েল আদালতে স্বীকাররোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
যেভাবে পরিকল্পনা ও হত্যা
মামলার অভিযোগপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাতটার দিকে ভৈরবের শিবপুর বাজারে একটি পুরি-শিঙাড়ার দোকানের সামনে বসে আসামি লিটন, রব্বানী, জুয়েল ও কাজল ইজিবাইক ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা ইজিবাইক ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ভৈরবের দুর্জয়ের মোড় বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিকাপ্রাসাদ যাওয়ার কথা বলে সোহেল ওরফে বদন খন্দকারের ইজিবাইকটি ১০০ টাকায় ভাড়া নেন।
ইজিবাইকটি কালিকাপ্রসাদের একটি ফাঁকা জায়গায় পৌঁছামাত্রই আসামি রব্বানী প্রস্রাব করার কথা বলে ইজিবাইকটি রাস্তার পাশে থামান। পরে চালক বদন খন্দকারকে ইজিবাইক থেকে নামিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলেন এবং সঙ্গে থাকা লোহার রড দিয়ে চালকের নাকে, মুখে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন। পরে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার মোবাইল ফোন ও ইজিবাইকটি নিয়ে পালিয়ে যান তারা।
ভৈরবের মুসলিম মোড় ব্রিজের কাছে অজ্ঞাত এক লোকের কাছে ৩০ হাজার টাকায় ইজিবাইকটি বিক্রি করেন আসামিরা। এই ৩০ হাজার টাকার মধ্যে কাজল সাত হাজার, রব্বানী সাত হাজার, জুয়েল তিন হাজার ও বাকি টাকা নিয়ে যান লিটন।
ঘটনার দুই/তিন মাস পর আসামি লিটন মিয়া অপর আসামি রব্বানীর শ্যালক জুয়েল মিয়ার মোবাইলের দোকানে মোবাইলটি ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। জুয়েল মিয়া মোবাইলের লক খুলে সেটি ভৈরবের শিমুলকান্দি ইউনিয়নের বাইশমা মধ্যপাড়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা জয়নাল আবেদীনের কাছে আট হাজার টাকায় বিক্রি করেন।