উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার ফুলজোড়, করতোয়া, ইছামতি, হুড়াসাগর ও চলনবিলসহ বিভিন্ন নদ-নদী ও জলাশয়ের পানি বেড়েই চলছে। এরই মধ্যে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
জেলায় তলিয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের ফসলি জমি। এতে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে। যমুনায় দ্রুত পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়ন, কাজিপুরের খাসরাজবাড়ি ইউনিয়নের সানবান্ধা ঘাট থেকে বিশুরি গাছা ঘাট ও শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের পাঁচিল, হাট পাঁচিল, জালালপুর ও সৈয়দপুর গ্রামে যমুনায় তীব্র ভাঙন চলছে। কোনো কিছুতেই ভাঙন থামছে না।
যমুনার তীব্র ভাঙনে সিরাজগঞ্জের তিনটি উপজেলার আট শতাধিক বসতবাড়ি ও হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে।স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বুধবার সকালে জানান, চলতি মৌসুমে যমুনা নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব অঞ্চলে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে জেলার কাজিপুর, সদর ও শাহজাদপুরে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অফিস সূত্রে জানা যায়, যমুনা নদীর ভাঙন রক্ষায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী, জালালপুর ও খুকনী ইউনিয়নের এনায়েতপুর থেকে পাচিল পর্যন্ত নদীতীরের সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও নদী খনন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের জুনে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ সমাপ্ত হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ।
নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধ নির্মাণ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।স্থানীয়রা জানান, ভাঙনের মুখে থাকা সদর উপজেলার কাওয়াকোল ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বড় কয়রা কমিউনিটি ক্লিনিকটি নিলামে বিক্রির জন্য সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিস প্রকাশ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া দুটি মুজিব কেল্লা, সাড়ে চার কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও বর্ণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে রয়েছে। গতকাল বিকেলে শাহজাদপুরের পাচিল গ্রামের কোবাদ মাস্টারের দোতলা ভবন নদীগর্ভে ধসে পড়েছে। এ ছাড়া অনেক ঘরবাড়িও নদীতে ভেঙে পড়ছে।
সহায় সম্বল হারিয়ে ভাঙনের শিকার পরিবারের মানুষ এখন নিঃস্ব।
সদর উপজেলার কাওয়াকোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান (জিয়া মুন্সি) বলেন, ‘নদীভাঙনে জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যেতে চলেছে কাওয়াকোলা ইউনিয়ন। ভাঙন রোধে পাউবো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কাওয়াকোলা ইউনিয়নের হাট বয়ড়া, দৌগাছী, বড়কয়রা, ছোট কয়রা, কৈগাড়ী দড়তা, চন্ডল বয়ড়া ও বেড়াবাড়ি গ্রামে তীব্র নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
‘অনেক গ্রাম এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। ভাঙনের কারণে কমিউনিটি ক্লিনিক নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে।’
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নদীভাঙনের কারণে যেকোনো মুহূর্তে বড়কয়রা কমিউনিটি ক্লিনিক নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ কারণে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নিলাম বিক্রির কমিটি গঠন করে প্রকাশ্যে নিলাম অনুষ্ঠিত হবে।’এদিকে শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পাকড়তলা গ্রামের লাল মিয়া ও পাচিল গ্রামের আলাউদ্দিন, কালাম শেখ, আয়নাল হকসহ অনেকেই অভিযোগ করেন, চলতি মৌসুমে নদীভাঙনে এলাকার অন্তত ৫ শতাধিক ঘর-বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে অনেক মানুষ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বিপুল পরিমাণে আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় তারা এখন ভূমিহীন। কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।
তাদের ভাষ্য, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঠিকাদাররা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করত, তাহলে তাদের এ সর্বনাশ হতো না।এ বিষয়ে জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী সুলতান মাহমুদ জানান, নদীভাঙনে খুকনী, কৈজুরী ও জালালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গত কয়েক বছরে জালালপুর ইউনিয়নের পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়েছে। এরই মধ্যে এসব অঞ্চলের শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। তিন বছরেও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শেষ না হওয়ায় নদীতীরের মানুষজনকে এমন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জের গেজ রিডার হাসান মামুন বুধবার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে পানি ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে।পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, নদীর পূর্বপাড়ে চর জেগে ওঠার কারণে প্রকল্প এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য নদীতে খননকাজ চলছে।
তিনি আরও জানান, ভাঙন রোধে কাজ করা হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় ভাঙন রয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগভর্তি বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে।