নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলা ইউনিয়নের কোলা গ্রামের ফুল মোহাম্মদ দম্পতি। বাড়িঘরের অবস্থা দেখলেই অনুমান করা যায় তাদের জীবনমান।
সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে বয়স্কভাতা পান ফুল মোহাম্মদ। সম্প্রতি মোবাইল ফোনে নগদ অ্যাকাউন্টের টাকা তুলতে গিয়েছিলেন আলহেরা টেলিকম নামের নগদ এজেন্টের দোকানে। সেখানে দোকানমালিক জুয়েল আরমানের ভাই সুমন হোসেন সুকৌশলে টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ বর্ষীয়ান এ ব্যক্তির।
তিনি জানান, এক মাস ধরে প্রতিকার না পেয়ে অবশেষে গত ২৬ জুন সমাজসেবা অফিসসহ একাধিক জায়গায় অভিযোগ করেন। এরপর টনক নড়ে সবার।গত ২৯ ও ৩০ জুন এলাকায় সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা ২৮ মের দুটি ট্রানজেকশনে দেখিয়ে জানান, বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে প্রথমবার ফুল মোহাম্মদের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে আলহেরার নগদের উদ্যোক্তার নম্বরে ১ হাজার ৮১৪ টাকা ১৯ পয়সা ক্যাশ আউট করা হয়। পরে পাঁচটা ১৯ মিনিটে একই নম্বরে ১ হাজার ৮০০ টাকা ক্যাশআউট করা হয়, কিন্তু দোকানদার সুমন ১ হাজার ৮০০ টাকা ভাতাভোগীর হাতে দেন এবং বাকি ১ হাজার ৮১৪ টাকা ১৯ পয়সা কৌশলে আত্মসাৎ করেন।
সুমন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ফুল মোহাম্মদের জরাজীর্ণ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দরজার সামনে বসে আছেন প্রতিবন্ধী স্ত্রী শরিফা। তিনিও সরকারি সুবিধাভোগীর আওতায় প্রতিবন্ধী ভাতা পান।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাকা দেন। সুমন সেই টাকা দেয়ার সময় খরচ কেটে নেন।ফুল মোহাম্মদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ২৮ মে আলহেরা টেলিকম নামের নগদ এজেন্টের দোকানে ভাতার টাকা ওঠাতে যান তিনি। সুমন একবারের ভাতার টাকা বের করে দেন ভাতাভোগীকে, কিন্তু দুইবারের প্রাপ্য ভাতার টাকা তার মোবাইলের নগদ অ্যাকাউন্টে জমা ছিল। জানতে গেলে সুমন সেই টাকার কোনো খোঁজ নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন।
এরপর ফুল মোহাম্মদ বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে সুমনের বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ করেন। অভিযোগে সুমন ও তার ভাইয়ের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
ভাতাভোগী এ ব্যক্তি জানান, সুমনের কাছে গেলে তিনি তাকে এক হাজার ৮০০ টাকা ধরিয়ে দেন, কিন্তু তার মোবাইল ফোনে দুইবার ভাতার টাকা এসেছে।
তিনি বলেন, ‘বাপো, হামার ভাতার ট্যাকা মেরে দিসে দোকানদার। হ্যামি গরিব মানুষ, বাপু। হামার সাথে সুমন এমনডা করল ক্যানো? হ্যামি হামার ভাতার ট্যাকা ফেরত চাই!’
আলহেরা মোবাইল টেলিকমে কথা হয় সুমনের সঙ্গে। ভিডিও বক্তব্য দিতে রাজি হননি তিনি। কথা বলার একপর্যায়ে গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমি এই সেক্টরে খুব দক্ষ। কারও পিন কোডের সমস্যা হলে আমার কাছেই আসে। ফুল মোহাম্মদের আগের টাকা ছিল, সেটা আমার জানা ছিল না।
‘আমি ইচ্ছে করে করিনি; কোনো কারণে হয়তো আমার ভুল হয়েছে।’
এদিকে এ প্রতিবেদক তার দোকানে অবস্থানকালে এক ব্যক্তি আসেন তার মেয়ের উপবৃত্তির টাকা ওঠাতে। মোবাইলটা দিয়ে দেন সুমনের হাতে। কোনো কিছু না বলাতেই কিছু টাকা বের করে দেন এ ব্যবসায়ী।
একইভাবে ভিডিও বক্তব্য দিতে রাজি নন জুয়েল আরমান, তবে তিনি একসময় স্বীকার করেন, পিন না দেয়া ব্যবসায়িক কৌশল। কারণ পিন না দিলে এ দোকানেই আসবেন সেবাগ্রহীতারা।
ফুল মোহাম্মদের ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত বলে বিষয়টি নিয়ে কিছু করার দরকার নেই বলে প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন জুয়েল।
এক হাজার ৮০০ টাকার জায়গায় এক হাজার ৮১৪ টাকা ১৯ পয়সা কীভাবে ক্যাশআউট হয়, এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর প্রতারণা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন সুমন ও তার সহোদর।
স্থানীয় জনি নামের এক নারী জানান, সুমনদের আগে ছিল পানের দোকান। এখন কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন তারা।
ব্যবসায়ী শামিম বলেন, ‘আমরা বহু দিন থেকে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ শুনছিলাম, কিন্তু সঠিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। এবার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেটা সে সুকৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে।’
আরেক ব্যবসায়ী ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হতদরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা করে নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দিচ্ছে। আর সহজ-সরল ওইসব হতদরিদ্রের পিন কোড নিজের কাছে রেখে বছরের পর বছর কৌশলে টাকা আত্মসাৎ করছে। মেসেজ ডিলিট করে দেয়া ও পিন নম্বর না দেয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’
কোলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহীনুর ইসলাম স্বপন বলেন, তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও মৌখিক অনেক অভিযোগ ছিল, কিন্তু প্রমাণ ছিল না। এবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুমনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসার রাজীব আহম্মেদ বলেন, ‘ভাতাভোগী ফুল মোহাম্মদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে গিয়ে আমরা প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়েছি। এ ছাড়া তার (সুমন) বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আমরা পেয়েছি।
‘এ রকম হতদরিদ্রদের টাকা যারা মেরে দেয়, তাদের বিচার হওয়া উচিত। আমরা বিষয়টি নগদকে জানিয়েছি। এখন তারা পদক্ষেপ নেবে।’