কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের বিষয়ে প্রতিদিনই বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
চিনি চোরাচালানে জড়িত থাকা ও যৌন নিপীড়নে সহায়তার অভিযোগের পর তার বিরুদ্ধে ঘর ভাড়া নিয়ে তা পরিশোধ না করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জেলা শহরের একরামপুর রেলক্রসিং সংলগ্ন গাজী মার্কেটে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন মোল্লা সুমন, তবে মার্কেট মালিক গাজী আবদুল হকের অভিযোগ, চার বছর ধরে তাকে একটি টাকাও ভাড়া দেননি তিনি।
গাজী আবদুল হক বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর ধরে মোল্লা সুমন তার মার্কেটের দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে বসে ছাত্রলীগের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন, তবে চার বছর আগে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে ঘর ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে ঘরপ্রতি সাড়ে ৪ হাজার টাকা ভাড়া দেয়ার কথা। সে হিসাবে দুইটি ঘরে প্রতি মাসে ৯ হাজার টাকা ভাড়া হয়।
‘গত চার বছরে চার লাখ টাকারও বেশি ভাড়া জমা পড়ে আছে সুমনের কাছে। ভাড়া চাইলে নানা টালবাহানা করে সে। যদি বেশি চাপ দিই, তবে তার সাথে ঝামেলা বাধবে। নিজের ক্ষতি হবে ভেবে ভাড়া চাওয়ার সাহস পাই না।’
অভিযোগের বিষয়ে কী বলছেন সুমন
এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা হয় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের সঙ্গে।
তার দাবি, গত ছয়-সাত বছর ধরে এখানে বসে ছাত্রলীগের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন তিনি। এক মাসেরও ভাড়া বাকি রাখেননি।
ভাড়া দেয়ার রসিদ আছে কি না জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ‘ঘর মালিক কাউকেই ভাড়ার রসিদ দেন না। এগুলো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ।’
কী বলছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘অপরাধীদের প্রশ্রয় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংগঠন এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ পরিপন্থি কাজের সাথে যারাই যুক্ত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে এ রকম অনেকের ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের ব্যাপারেও তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
চিনি চোরাচালান চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগ
ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে চিনি এনে দেশে বিক্রি চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন ও তার স্বজন নাজমুল হীরার বিরুদ্ধে। হীরা নিজেও ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন।
সুমন-হীরা একা নন, তাদের অনুসারীরাও এই কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কথোপকথনের স্ক্রিনশট ফাঁস হয়েছে।
সম্প্রতি চোরাচালানের চিনিসহ একটি ট্রাক আটক করে পুলিশ। ট্রাকটি সুমন ও হীরার ঘনিষ্ঠ একজন আনেন বলে খবর চাউর হয়। অথচ মামলার আসামি করা হয় ছাত্রলীগের অন্য এক নেতাকে। ওই নেতার দাবি, চোরাই চিনিবোঝাই ট্রাক ধরিয়ে দিতে তিনি সহযোগিতা করেছেন।
দেশে প্রতি কেজি চিনির দাম ১৪০ টাকা হলেও ভারতে দাম ৫০ রুপির মতো। ফলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনেকে চিনি নিয়ে এসে অবৈধভাবে দেশে বিক্রি করেন। সম্প্রতি সিলেট ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চিনি চোরাকারবারে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
অটোরিকশা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি
শহরের বিভিন্ন সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের এ নেতার বিরুদ্ধে।
সংগঠনের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান নয়ন বলেন, ‘এমন কোনো দপ্তর নেই যেখানে জেলা ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজি হয় না। স্ট্যান্ডগুলোতে ছাত্রলীগের সভাপতি ও তার অনুসারীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদের অত্যাচার ও মামলার হুমকি দেয়া হয়।’
তার দাবি, শহরের একরামপুর ও পুরানথানা সিএনজি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন হীরা।
তিনি জানান, সিএনজি অটো স্ট্যান্ডের জায়গা মালিকপক্ষ ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের কাছ থেকে দৈনিক ভিক্তিতে ভাড়া নিয়েছেন নাজমুল হীরা। একেক দিন একেক লোককে সুপারভাইজার হিসেবে নিয়োগ করে অটোরিকশা থেকে প্রতি ট্রিপে ৫০ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে থাকেন তিনি।
প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি অটোরিকশা পুরানথানা ও একরামপুর থেকে চামটাঘাট ও বালিখলায় যায়। একরামপুর থেকে কিছু অটোরিকশা ভৈরব এবং গাজীপুরেও যায়। সে হিসাবে দিনে ১৫০ থেকে ২০০ অটোরিকশা চলে।
প্রতিদিন এভাবে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়, যা মাসে দাঁড়ায় চার লাখ টাকার মতো।
কমিটি গঠনে বাণিজ্য
২০২২ সালের ৫ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হোসেনপুর ও পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ।
পরদিন সকালে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হোসেনপুর উপজেলা ছাত্রলীগের একাংশ। তারা জানায়- বিবাহিত, অছাত্র, বয়সোত্তীর্ণ ও মাদকাসক্তদের কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়েছে।
টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ এনে হোসেনপুর উপজেলা ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটিকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে।
একই দিন পাকুন্দিয়াতেও বিক্ষোভ কর্মসূচি ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে ছাত্রলীগের একাংশ। তাদের অনেকেই ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেন।
সে সময় পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. আরমিন দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার কথা বলে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হন।
তিনি বলেছিলেন, ‘বিবাহিত, অছাত্র, মাদকাসক্ত, বয়সোত্তীর্ণ, বিএনপি-জামায়াত পরিবার থেকে উঠে আসা সুবিধাবাদীদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে কমিটিতে নেয়া হয়েছে। এটা উপজেলা ছাত্রলীগের কাঠমোকে দুর্বল করে দেয়ার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র।’
এ বিষয়ে তখন মৌনতা অবলম্বন করেন মোল্লা সুমন।
২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিন সদস্যের জেলা কমিটির অনুমোদন দেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।
কমিটিতে আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনকে সভাপতি, ফয়েজ ওমান খান সাধারণ সম্পাদক ও লুৎফর রহমান নয়নকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। সেই কমিটি পার করে চারটি বছর। শুরু থেকেই এ কমিটিকে মানতে নারাজ ছাত্রলীগের একটি পক্ষ।