ঈদের ছুটি শেষে অফিস শুরুর প্রথম দিন বুধবার থেকেই রাজধানী ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নগরমুখী মানুষের ভিড় শুরু হয়। বৃহস্পতিবারও ছিল একই চিত্র।
গ্রামে যাওয়া মানুষেরা ক্রমে ক্রমে ঢাকা ফিরতে থাকায় চাপ কম লক্ষ্য করা গেছে সদরঘাটে। শুক্র-শনিসহ ঈদের তিন দিন মিলে পাঁচদিনের লম্বা ছুটি শেষে কর্মমুখী মানুষ ঢাকায় ফিরতে থাকায় বৃহস্পতিবারও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা যাত্রীর চাপ ছিল সদরঘাটে। তবে যাত্রীর উপচেপড়া ভিড় বলতে যা বুঝায় তেমনটা দেখা যায়নি।
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের লঞ্চগুলো ডেকে পরিপূর্ণ যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের পন্টুনে ভিড়তে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
দুপুরের পর থেকে গ্রিন লাইন-৩ ও সন্ধ্যার পর পারাবত-৯, ১০, ১২ ও ১৮; মানামী, কুয়াকাটা-২, কীর্তনখোলা-২ ও ১০, সুরভী-৮ ও ৯, অ্যাডভেঞ্চার-১ ও ৯, সুন্দরবন-১২ লঞ্চসহ মোট ১৫টি লঞ্চ বরিশাল নদীবন্দর থেকে সদরঘাটে এসে পৌঁছায়।
ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়েও কিছু লঞ্চ ঢাকায় এসে পৌঁছায়। এছাড়াও নিকটবর্তী জেলা চাঁদপুর, ভোলা, ইলিশা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোও ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সদরঘাট টার্মিনাল থেকে দেশের ৩১টি নৌপথে নিয়মিত ৭০টি লঞ্চ চলাচল করে। তবে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তা দ্বিগুণের বেশি করা হয়েছে। ঈদের আগে-পরের প্রায় ১৫ দিন ছোট-বড় মিলিয়ে ১৭৫টিরও বেশি লঞ্চ যাতায়াত করেছে। আগে ঢাকা থেকে ৪১টি নৌপথে লঞ্চসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন নৌযান চলত। নদী খনন ও ড্রেজিংয়ে অনিয়মের কারণে ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলগামী ১০টি নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
সরকারি ছুটি শেষ হওয়ায় কর্মস্থল ঢাকায় ফিরতে লঞ্চে মানুষের ঢল নেমেছে বলে জানিয়েছেন জাহাজ মালিক, স্টাফ ও কর্মকর্তারা।
মানামি লঞ্চের চালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এবার ঈদের আগে যেমন যাত্রী চাপ ছিলো পরে তেমন হচ্ছে না। সরকারি ছুটি শেষ হওয়ায় অনেকেই এখন ঢাকা ফিরছে। তবে অনেকে বুধ ও বৃহস্পতি ছুটি নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সামনের সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন বিশেষ করে শনিবার যাত্রীর চাপ অনেকটা বাড়বে।’
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী থেকে ফিরেছেন ঢাকায়। তিনি বলেন, ‘এমভি টিপু-৭ লঞ্চের টিকিট পেয়েছিলাম। তবে লঞ্চে অনেক মানুষের ভিড় ছিলো। ঠিকভাবে ঢাকায় আসতে পেরেছি এটাই অনেক।’
মনপুরা থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় এসেছে এমভি তাসরিফ-৮। লঞ্চটির কর্মী আসাদ মুন্সি বলেন, ‘এই ট্রিপে পাঁচ-ছয়শ’ মানুষ এসেছে। ছুটি শেষ হওয়ায় মানুষ ঢাকায় ফিরছে। আরামের যাত্রা লঞ্চ। এজন্য অনেকেই লঞ্চে যাতায়াত করেন।’
ভোলার চরফ্যাশন ও বেতুয়া থেকে ছেড়ে সন্ধ্যায় সদরঘাটে ভিড়েছে এমভি টিপু-১৩। লঞ্চটিতে ঘাটে ভিড়তেই দেখা যায়, ডেকভর্তি মানুষ। অনেকে দাঁড়িয়েও এসেছেন।
ভোলা থেকে আসা যাত্রী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কাপড়ের দোকানে কাজ করি। ঈদের আগের দিনও খোলা ছিল। চাঁদ রাতে ঈদ করতে ঢাকা থেকে বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছুটি শেষ, মার্কেট খুলবে। এজন্য আবার চলে আসলাম।’
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশালগামী লঞ্চগুলোতে যাত্রী কমায় ঢাকার সদরঘাটের চেনা রূপ অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। ঈদের ছুটির সঙ্গে ফিরেছে চেনা সেই ভিড়। তবে ঈদের পর ঢাকার সদরঘাটে ভিড় বাড়লেও আগের মতো যাত্রী নেই বলে জানিয়েছেন লঞ্চ-সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় থাকলেও লঞ্চে ফিরতি পথের যাত্রী ভিড় অনেকটাই কম। বরিশাল ও ভোলার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা লঞ্চগুলোর কর্মীরা যাত্রীদের ডাকাডাকি করছেন। অল্পসংখ্যক মানুষ লঞ্চে উঠেছেন। বেশ কয়েকটি লঞ্চের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ডেকের সিট অধিকাংশই ফাঁকা। ভেততে কিছু মানুষ বসে আছে। কেউ আবার কেবিন নিয়ে দরদাম করছেন।
নৌপথেই স্বস্তি খুঁজবে যাত্রীরা- এবারের ঈদযাত্রায় এমনটা প্রত্যাশা ছিলো লঞ্চ মালিকদের। তবে ঈদের পর তা আবার কমে যাওয়ায় হতাশ তারা।
ডলার কোম্পানির ২৪টি লঞ্চের মালিক ও যাত্রী পরিবহন সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের লঞ্চ আছে অনেক। কিন্তু সে অনুযায়ী যাত্রী নেই। তাই লঞ্চ কম ছাড়ছে। যেগুলো ছাড়ছে সেগুলো যাত্রী ভরেই যাচ্ছে। ঈদের পরও আমরা যাত্রীর চাপ আশা করেছিলাম। কিন্তু পাইনি।’
লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ঈদের আগে যাত্রীর চাপ বাড়ায় আশা পেয়েছিলাম। এখন সে আশা আর দেখছি না। সামনের দিনগুলোতে কী হয় দেখা যাক।’
সার্বিক বিষয়ে ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ-এর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন জানান, ‘ঈদের পর যাত্রীর চাপ স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের নিয়মিত লঞ্চগুলোই চলাচল করছে। অতিরিক্ত কোনো লঞ্চের প্রয়োজন পড়ছে না। আর ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।'
টার্মিনাল এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সদরঘাট নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) যাত্রীর চাপ আগের থেকে বেড়েছে। পুলিশ, র্যাবসহ আনসার সদস্যরা যাত্রীদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। সন্দেহজনক কিছু দেখলে তল্লাশিও চালানো হচ্ছে। যাত্রীর চাপ বাড়লে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।’