বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তিন আতঙ্কে সিলেটবাসী

  •    
  • ১৪ জুন, ২০২৪ ২২:৩৭

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত ২২ মে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার পানি এখন পর্যন্ত পুরো নামতে পারেনি। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে সিলেটে আবার ঢল নামতে শুরু করেছে। ফলে আবার বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দারা রয়েছেন ধস আতঙ্কে।

বছরজুড়ে বৃষ্টির জন্য সিলেটের আবহাওয়ার খ্যাতি ছিল। অথচ এখন ভারি বৃষ্টি আর ঢল আতঙ্ক হয়ে উঠেছে সিলেটের বাসিন্দাদের জন্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলাবদ্ধতা ও টিলা ধসের ভয়।

গত ১২ দিনে অন্তত চারবার সিলেট নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় নগরের নিচু এলাকাগুলো। পানি উঠে যায় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে। ফলে বৃষ্টি এখন নগরের নিচু এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের জন্য আতঙ্কের নাম।

এদিকে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত ২২ মে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার পানি এখন পর্যন্ত পুরো নামতে পারেনি। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে সিলেটে আবার ঢল নামতে শুরু করেছে। ফলে আবার বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দারা রয়েছেন ধস আতঙ্কে।

গত ১০ জুন সিলেট নগরের মেজরটিলা এলাকার চামেলিবাগে একটি টিলা ধসে মাটি চাপা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়। টানা বৃষ্টির কারণে এরপর থেকে বেড়েছে টিলা ধস আতঙ্ক।

বন্যা নিয়ে আতঙ্ক

ভারি বৃষ্টি ও হঠাৎ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত ২২ মে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলা জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ।

এসব উপজেলার বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েন লাখো মানুষ। অবশ্য ঢল থামার পর চলতি মাসের শুরুর দিকে পানি কমতে শুরু করে, তবে বৃহস্পতিবার থেকে সিলেটে ফের বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

ফের ভারি বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটের উজানের ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে। ফলে ঢলও নামতে শুরু করেছে। এতে সিলেটের নদ-নদীর পানি বেড়ে আবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঢল অব্যাহত থাকলে আবার বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিলেটে এরই মধ্যে ৫৫১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঈদের ছুটিতেও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘন্টায় ৩৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। বৃষ্টি হয় অন্য রাজ্যেও। আগামী কয়েক দিন এসব এলাকায় ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্যোগ পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ছুটির সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সব কর্মকর্তাকে প্রস্তুত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢলের পানিতে সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

১১ দিনে চারবার তলিয়ে গেল সিলেট নগর

সিলেট নগরের বাসিন্দাদের দুর্ভোগের অপর নাম হয়ে উঠেছে জলাবদ্ধতা। ভারি বৃষ্টি হলেই নগর জলমগ্ন হয়ে পড়ে; তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট। বাসাবাড়িতেও ঢুকে পড়ে পানি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।

গত ১১ দিনে সিলেট নগরে চারবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ১১ দিনের ব্যবধানে চতুর্থবারের মতো নগর প্লাবিত হয়।

এর আগে ২ জুন রাতে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তখন অধিকাংশ এলাকার পানি পরের দিন নেমে যায়, তবে অন্তত ১২টি এলাকার পানি নামতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল।

এ অবস্থায় ৮ জুন রাতে আবারও ভারি বৃষ্টিতে সিলেট নগরের শতাধিক এলাকা প্লাবিত হয়। পরে ১০ জুন আবারও বৃষ্টিতে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, সিলেটে বৃহস্পতিবার ১২ ঘণ্টায় ২০২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, সিলেটের আকাশে বজ্রমেঘ অবস্থান করছে। এর প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ব্যাপক বজ্রপাতও হতে পারে।

বৃষ্টি হলেই নগরের উপশহর, তেরোরতন, সোনারপাড়া, সোবহানীঘাট, শিবগঞ্জ, যতরপুর, মাছিমপুর, শেখঘাট, তালতলা, দরগাহ মহল্লা, কদমতলীসহ অর্ধশতাধিক এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এলাকাগুলোর অনেক বাসায় পানি ঢুকে পড়ে।

নগরের দরগাহ মহল্লা এলাকার বাসিন্দা আবদুল বাতেন বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি ঢুকে যায়। গত কয়েক দিনে ঘরের মধ্যে চারবার পানি ঢুকেছে। অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। এখন বৃষ্টি হলেই আতঙ্কে থাকি।’

এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘পানিতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক দিন ধরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পানি দ্রুত নামতে পারছে না। এ কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।

‘বৃষ্টি কমে গেলে পানিও নেমে যাবে, তবে নগর যেন জলাবদ্ধ না হয়, সে জন্য আরও কী করা যায়, সেসব বিষয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে।’

টিলা ধস

প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে সিলেটে টিলা ধসের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহতও হন অনেকে। ফলে বৃষ্টির মৌসুম শুরু হলেই টিলা ধস আতঙ্ক দেখা দেয়। এই আতঙ্ক আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে ১০ জুনের পর। ওই দিন সকালে নগরের মেজরটিলা এলাকার চামেলিবাগে একটি টিলা ধসে মাটি চাপা পড়ে একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যু হয়।

ওই দিন সকাল ছয়টার দিকে মেজরটিলায় চামেলিবাগ এলাকার দুই নম্বর সড়কের একটি টিলা ধসে ৮৯ নম্বর বাসার ওপর পড়ে। এতে এই বাসায় ভাড়া থাকা ছয় সদস্য মাটির নিচে চাপা পড়েন। তিনজনকে তাৎক্ষণিক জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের আহত অবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর প্রায় ছয় ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাকি তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

নিহত তিনজন হলেন আগা করিম উদ্দিন (৩১), তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার রুজি (২৫) ও তাদের শিশু সন্তান নাফজি তানিম ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘সিলেটে নির্বিচারে পাহাড় ও টিলা কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়।

‘ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলা ধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’

তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলায় টিলা ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৬ জুন জৈন্তাপুর উপজেলায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। পাহাড় বা টিলা ধসে মানুষের মৃত্যু হলে প্রশাসন কিছুদিনের জন্য তৎপর হয়। তারপর আবার চুপ হয়ে যায়।’

সিলেটের পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে ২০১২ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার ওপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনবার্সনের নির্দেশনা দেয়া হয়।

সিলেট নগর লাগোয়া দলদলি চা বাগানের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, টিলার পাদদেশে সারিবদ্ধভাবে ঘর বানিয়ে তাতে বসবাস করছেন চা শ্রমিকরা। অতি বৃষ্টিতে উঁচু টিলার মাটি একটু একটু করে ধসে পড়ছে। যেকোনো সময় পুরো টিলা ধসে ঘরগুলোর ওপর পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবু ঝুঁকি নিয়েই এসব ঘরে বসবাস করছেন চা শ্রমিকরা।

এখানকার একটি ঘরের বাসিন্দা সাবিত্রী নায়েক বলেন, ‘আমাদের নিজের কোনো জমি নাই। বাগান কর্তৃপক্ষ এইখানে থাকার জায়গা দিয়েছে। তাই এখানে থাকতে হয়েছে।’

ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাতে ভারি বৃষ্টি হলে মাঝে মাঝে টিলার মাটি একটু একটু টিনের চালে এসে পড়ে। এমন রাতে আর ঘরের কেউ ঘুমাতে পারি না। বারান্দায় বসে কেবল ঠাকুর দেবতার নাম জপ করি।’

বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসাব অনুযায়ী, সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪০০ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলার ওপর ও পাদদেশে অনেক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শ পরিবার। এ ছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।

টিলার পাদদেশে ঝুকি নিয়ে বসবাস ও প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বেলা সিলেটের সমন্বয়ব শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ‘২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড় টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন, কিন্তু ওই রায়ের ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।’

এ বিষয়ে সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘গত ২৮ মে থেকে সিলেটে টানা ভারি বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস না করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন সতর্কতামূলক প্রচারণা চালিয়েছে, যা এখনও অব্যাহত। এ ছাড়া কেউ যেন টিলা কাটতে না পারেন, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কড়া নজরদারি রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘টিলার ওপরে ও পাদদেশে যারা বসবাস করেন, চেষ্টা করেও তাদের অন্যত্র সরানো যায় না। গত বছরও আমরা সব ইউএনওদের মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি, কিন্তু কেউ কথা শোনেনি।’

এ বিভাগের আরো খবর