নীলফামারীর জলঢাকার মীরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যানের এমন আচরণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ওই ইউনিয়নের সচিব পরিষদে আসেন না প্রায় দুই মাস ধরে।
চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা মানিক ও সচিব মানিক চন্দ্র রায়ের অনিয়মে সেবা নিতে আসা অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে মঙ্গলবার ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে যায়, ভিউব্লিউবি কার্ডের (পূর্ব নাম ভিজিডি) চালের জন্য পরিষদে জড়ো হয়েছেন নারীরা। কিন্তু চেয়ারম্যান-সচিব কেউ আসেননি পরিষদে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ইউনিয়ন পরিষদ ত্যাগ করেন তারা।
জানা যায়, ভিউব্লিউবি কার্ডের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ৩২৯ জন উপকারভোগীদের থেকে পরিষদের গ্রাম পুলিশ মাহমুদের মাধ্যমে প্রতিজনের কাছে ১১০০ টাকা নেন চেয়ারম্যান মানিক। প্রতিমাসে ভিউব্লিউবি কার্ডের ২২০ টাকা ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
টাকা নিলেও চেয়ারম্যান উপকারভোগীদের নামে কোনো অ্যাকাউন্ট খোলেননি। উল্টো উপকারভোগীদের ১৪ মাসের জমানো টাকারও কোনো হদিস নেই। প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল দেয়ার কথা থাকলেও কোনো মাসে ২০ কেজি, কোনো মাসে ২৫ কেজি চাল দেয়া হয়। গত মার্চ মাস থেকে দেয়া হয়নি ভিউব্লিউবি কার্ডের ৩০ কেজি চাল।
অভিযোগ আছে, এ ছাড়াও তিন মাস ধরে সচিব ইউনিয়ন পরিষদে না আসায় জন্ম নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সেবা নিতে সাধারণ জনগণ চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছে। সচিবের একটি স্বাক্ষরের জন্য দিনে পর দিন ধরনা দিতে হচ্ছে পরিষদে। চেয়ারম্যান-সচিবের এমন অনিয়মের ফলে হয় না পরিষদের মাসিক সভা। যার ফলে দীর্ঘ তিন বছর ধরে পরিষদে নেই বৈদ্যুতিক সংযোগ।
ভুক্তভোগীরা জানান, এমন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ট হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা চেয়ারম্যানের বিভিন্ন অর্থ বছরের প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থের নয়ছয়, ভুয়া রেজুলেশন করে টাকা আত্মসাৎ, টিসিবি কার্ডসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয়নি।
ভিউব্লিউবি কার্ডের উপকারভোগী মেরিনা বেগম, মোছা. আরজু ও মোছা. আখিমা বেগমসহ আরও অনেকে জানান, তাদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কথা বলে মাহমুদ চৌকিদারের মাধ্যমে ১১০০ টাকা করে নেন চেয়ারম্যান মানিক। প্রতিমাসে ভিউব্লিউবি কার্ডের ২২০ টাকা জমা ওই অ্যাকাউন্টে জমা হবে বলে জানান তারা। দীর্ঘ ১৪ মাস টাকা জমানোর পরেও আমাদের ফোনে টাকা জমানোর কোনো এসএমএস না আসলে তারো ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাদের নামে কোনো অ্যাকাউন্টই খোলা হয়নি।
তারা জানান, এ ছাড়াও ৩০ কেজি চাল দেয়ার কথা থাকলেও কোনো মাসে ২০ কেজি, কোনো মাসে ২৫ কেজি চাল দেয়া হয় তাদের। চাল নিতে আসতে একদিন দেরি হলেই অর্ধেক বস্তা চাল দেয়। গত দুই মাস থেকে কার্ডের চাল পাননি।
জন্ম নিবন্ধনে স্বাক্ষর নিতে আসা মীরগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব শিমুলবাড়ী এলাকার বাসিন্দা বাবু সুরেষ চন্দ্র রায় বলেন, ‘বাচ্চার জন্ম নিবন্ধনের জন্য তিন মাস ধরে ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছি। কোনোভাবে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিতে পারলেও সচিবে স্বাক্ষর এখনও নিতে পারিনি। প্রতিদিনই ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আসি স্বাক্ষরের জন্য, কিন্তু একদিনও সচিবের দেখা পাইনি।’
পাঠানপাড়া এলাকার জিল্লুর রহমানের স্ত্রী জোৎসনা বেগম বলেন,‘ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ ছেলের জন্ম নিবন্ধন চেয়েছে। পরিষদের থেকে জন্ম নিবন্ধন নিয়েছি। কিন্তু এতে চেয়ারম্যান ও সচিব কারোর স্বাক্ষর নেই। সাত-আট দিন ধরে স্বাক্ষরের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছি। চেয়ারম্যান-সচিব কারোই দেখা পাচ্ছি না। এখন আমি তাদের কোথায় খুঁজব আপনিই বলেন।’
মীরগঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম রব্বানী বলেন,‘মার্চ মাস থেকে পরিষদের কোনো সভা হয় না। চেয়ারম্যান-সচিব কেউ পরিষদে আসে না। পরিষদের হিসাব রক্ষক সবাইকে খবর দেয় আজকে ভিউব্লিউবি কার্ডের চাল দেয়া হবে। কিন্তু দুপুর ১টা বাজলেও চেয়ারম্যান সচিব কেউই আসেনি। ফলে বাধ্য হয়ে চাল নিতে আসা সবাই চলে যায়।’
পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য রোকসানা বেগম বলেন,‘ভিউব্লিউবি কার্ডের অ্যাকাউন্ট খোলার কথা বলে চৌকিদারের মাধ্যমে প্রত্যেকের কাছে ১১০০টাকা করে নেন চেয়ারম্যান। তাদের অ্যাকাউন্ট তো খোলা হয়নি উল্টো তাদের প্রতিমাসে ২২০টাকা করে জমা দেয়া ১৪ মাসের টাকার কোনো হদিস নেই। এসব টাকা চেয়ারম্যান আত্মসাৎ করেছে।’
৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রফিক খান বলেন,‘দুই মাস ধরে সচিব চেয়ারম্যান কেউই পরিষদে আসে না। ট্রেড লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধনসহ বিভিন্ন কাজে পরিষদে আসা মানুষেরা ফেরত যাচ্ছে। পরিষদে আমাদের ইউপি সদস্যদের কোনো বসার জায়গা নেই। দীর্ঘ তিন বছর ধরে পরিষদে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। নানা অনিয়ম দূর্নীতির কারখানা হয়ে পড়েছে পরিষদ।’
ভিউব্লিউবি কার্ডের অ্যাকাউন্ট খোলার টাকা নেয়ার বিষয়ে গ্রাম পুলিশ মাহমুদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,‘ আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। চেয়ারম্যান যা আদেশ করেন তাই করি। সব কিছু চেয়ারম্যান জানেন।’
পরিষদে না আসার বিষয়ে জানতে সচির মানিক চন্দ্র রায়ের ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা মানিকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,‘আজকে আমি অসুস্থ। আপনাদের সাথে আগামীকাল (বুধবার) কথা হবে।’
জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জি.আর সারোয়ার বলেন,‘এসব বিষয়ে আমার জানা ছিল না। আর আমাকে কেউ অভিযোগও করেনি। বিষয়টি এখন জানলাম তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সচিব ইউনিয়ন পরিষদে না আসার বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘সচিব দুই মাস ধরে পরিষদে আসেনি এটি সম্পর্কে আমি জানতাম না। আর কেউ আমাকেও জানায়ওনি। আপনি জানালেন, আমি খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’