বাবা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) ও ছেলে হোমিও চিকিৎসক, কিন্তু ছেলের হোমিও চিকিৎসালয়ে বাবা ও ছেলে মিলে মোটা টাকার বিনিময়ে জাল কাগজ তৈরি করে বিবাহ রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ নিয়ে আদালতে প্রতারণার মামলাও হয়েছে কাজির নামে।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ৫ নম্বর মটমড়া ইউনিয়নের কাজি মুঞ্জুর আহমেদ ও তার ছেলে হোমিও চিকিৎসক মুস্তাক আহমেদের বিরুদ্ধে উঠেছে এ অভিযোগ।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মুন্দা গ্রামের চব্বিশ বছর বয়সি দিনমজুর এক যুবকের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে একই গ্রামের এক নারীর সঙ্গে। সম্পর্কের একপর্যায়ে পরিবারের অমতে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাজি অফিসের খোঁজে চলে যান মটমুড়া ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রারের ছেলে মুস্তাক আহেমেদের কার্যালয় মুস্তাক হোমিও হলে।
ওই যুবক জানান, সেখানে মুস্তাক নিজেকে কাজি হিসেবে পরিচয় দেন এবং সাত হাজার টাকায় বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে দেবে বলে চুক্তি করেন। সেই বিশ্বাসে তাকে টাকা পরিশোধ করলে তিনি বর কনের স্বাক্ষর নিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে দেন।
তার কয়েকদিন পর ওই যুবককে নিকাহনামার অনুলিপিও প্রদান করেন মুস্তাক।
যুবক বলেন, ‘আমার স্ত্রীর বাবা বিয়ের কথা শুনে স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে আমার বাড়িতে যায়। তার মেয়েকে ফেরত চাইলে আমি জানাই, সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। তখন আমি বিয়ের কাগজ পত্র দেখাই। সেই কাগজ নিয়ে তার পরিবারের লোকজন সেখান থেকে চলে যায়, কিন্তু পরদিন তারা পুলিশ সঙ্গে করে নিয়ে এসে পুনরায় গিয়ে বলেন বিবাহের কাগজ পত্র নাকি জাল। এই বলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে তার বাবা বাড়িতে চলে যায়।’
পরে ওই যুবক কাগজ পত্র যাচাইবাছাই করতে গিয়ে দেখেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কাগজের বিষয়ে মুস্তাকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তার বিয়ের কাগজ তিনি পাশের জেলার মিরপুর উপজেলার আমলা সদরপুর ইউনিয়নের কাজির কাছ থেকে করে এনে দিয়েছেন। আমলা কাজির কাছে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তিনি এ বিষয়ে জানেন না।’
এ যুবকের মতো মুস্তাকের কাছে থেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন একই উপজেলার অনেকেই, তবে লোক-লজ্জা ও স্থানীয় প্রভাবের কারণে কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
অভিযোগকারী ওই যুবক আরও বলেন, ‘মুস্তাক পেশায় একজন হোমিও চিকিৎসক, তার বাবা একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার হলেও সে নিজে কাজি সেজে বিভিন্ন কাজির সিল-স্বাক্ষর জাল করে বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন করে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে।’
যুবকের চাচা টাল্টু মিয়া বলেন, ‘কাজি মঞ্জুর ও তার ছেলে মুস্তাক আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময়ে বিয়ে ও তালাকের নামে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে আসছে। তার বিরুদ্ধে আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করব।’
স্থানীয়রা জানান, বামন্দী জামান ফিলিং স্টেশনের পেছন পাশে অবস্থিত মঞ্জুর হোমিও হলে বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন করতে এসে এমন প্রতারিত হয়েছেন অনেকেই।
২০২২ সালে একই উপজেলার তেরাইল গ্রামের মো. রাশেদ বাদি হয়ে মেহেরপুর আদালতে কাজির নামে একটি প্রতারণার মামলা করেন। সেই মামলায় কাজি মুন্জুর আহমেদকে বিজ্ঞ আদালত কারাগারে পাঠায়। ওই মামলায় কাজি মঞ্জুর আহমেদ মাস খানেক হাজতে ছিলেন।
রাশেদ বলেন, ‘কাজি অনেক টাকার বিনিময়ে আমার সাথে বিবাহের কাবিননামা বানিয়ে আমাকে প্রতারণায় ফেলেছেন। আমাদের সেই মামলা বতর্মান এখনও আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে।’
আরেক অভিযোগকারী গ্রামের ইউপি সদস্য হিরোক আহমেদ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের একজন প্রবাসে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। তার মরদেহ পরিবারের কাছে দেশে ফেরত আনার জন্য বিয়ের কাবিন নামার প্রয়োজন হলে, মনজুর কাজির কাছে যোগাযোগ করলে তিনি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে কাবিন করে দেন। অথচ প্রবাসে থাকা সেই ভাই তাদের বিয়ে কোনোদিন রেজিস্ট্রেশনই করেননি।’
অভিযুক্ত মুস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আমার বাবা মুন্জুর আহমেদ ৫ নম্বর মটমুড়া ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার। সে হিসেবে আমাকে অনেক সময় কাজ দেখা শোনা করা লাগে এটা সঠিক, তবে অভিযোগকারীদের বিয়ের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
কাজি মুঞ্জুর আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের জাল কাগজে কোনো বিয়ে আমরা রেজিস্ট্রি করি নাই। মানুষজন অভিযোগ করতেই পারে। মামলা হতেই পারে। আমার বয়স হয়ে গেছে তাই ছেলে আমাকে সহযোগিতা করে।’
জেল খাটার বিষয়ে বললে তিনি বলেন, ‘জেল খাটা মানে এই না যে আমি অপরাধী। মামলাটি যেহেতু এখনও বিচারাধীন আছে। এমন মামলা তো অনেকের নামেই আছে।’
মেহেরপুর জেলা কাজি সমিতির সভাপতি খাইরুল বাশার বলেন, ‘কাজির সহযোগী হয়ে কেউ সহযোগিতা করতে পারবেন, কিন্তু কাজির অনুপস্থিতিতে কোনো বিবাহ রেজিস্ট্রি করা যাবে না। জাল বিয়ে রেজিস্ট্রি করলে সেই কাজির বিরুদ্ধে জেলা রেজিস্ট্রার আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এমনকি তার লাইসেন্স বাতিল করতেও পারবেন।
‘আর কাজি মঞ্জুর আহমেদ এর আগে একটি জাল বিয়ে দেয়ার কারণে কারাগারেও গিয়েছেন। বতর্মানে তিনি জামিনে আছেন।’
মেহেরপুর জেলা রেজিস্টার সাইফুল ইসলাম বলেন, এমন কাজ যদি নিকাহ রেজিস্ট্রার মঞ্জুর আহমেদ করে থাকেন। তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।