ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার পরিকল্পনা করা হয় রাজধানী ঢাকায় বসে। এই তথ্য জানানোর পাশাপাশি সেই হত্যা-পরিকল্পনার পুরো বর্ণনা তুলে ধরেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার প্রধান হারুন অর রশীদ।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর মিণ্টো রোডে ডিএমপি ডিবি কার্যালয়ে এমপি আনার হত্যার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন তিনি।
হারুন অর রশীদ জানান, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি ফ্ল্যাটে একাধিক বৈঠক করেন হত্যাকারীরা। এই পরিকল্পনা নিয়ে দুই থেকে তিন মাস ধরে একের পর এক বৈঠক চলে।
ভিকটিম (এমপি আনার) প্রায়ই ভারতের কলকাতায় আসা-যাওয়া করতেন। তাই কলকাতার মাটিতেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর সে অনুযায়ী মূল হত্যাকারী আমানুল্লাহ, তার সহযোগী তানভীর ভূঁইয়া ও আখতারুজ্জামান শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমান গত এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ কলকাতায় যান।
কলকাতায় আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। আর কলকাতায় আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন আখতারুজ্জামানের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার ছক সাজান। মূল হত্যাকারীর নাম শিমুল ভূঁইয়া হলেও তিনি আমানুল্লাহ আমান নামে নতুন একটি পাসপোর্ট করে কলকাতায় যান।
ডিএমপি ডিবি প্রধান আরও জানান, হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে ফিরে আসেন আখতারুজ্জামান। এমপি আনার যে ১২ মে কলকাতায় যাবেন তা আগে থেকেই জানতেন আখতারুজ্জামান। ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।
হারুন বলেন, ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি এমপি আনারকে ১৩ মে দুপুরে সাদা একটি গাড়িতে রিসিভ করেন। পরে হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারীদের অন্যতম আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভুইয়া ও ফয়সালসহ আনার ওই ফ্ল্যাটে যান। এরপর মোস্তাফিজ নামে আরও একজন ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। জিহাদ ও সিয়াম নামে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও দুজন সেখানে ছিলেন।
১৩ মে বেলা ২টা ৫১ মিনিটে এমপি আনার কলকাতার ওই বাসায় যান। এ সময় তারা এমপির কাছে আখতারুজ্জামানের পাওনা টাকা পরিশোধের প্রসঙ্গ তোলেন। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে ঝাপটে ধরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে। আধ ঘণ্টার মধ্যে ওরা হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি শেষ করে। হত্যার পর আমান বিষয়টি আখতারুজ্জামানকে জানান।
এমপি আনারকে হত্যার পর তার মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় জানিয়ে ডিবির হারুন বলেন, ‘আখতারুজ্জামানের পরামর্শমতো মরদেহ গুম করতেই ঘাতকরা এই কাজ করে। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিংমল থেকে আনা হয় দুটি বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। পরে দেহের টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। এরপর ভিন্ন ভিন্ন দিনে সেগুলো ফ্ল্যাটের বাইরে নিয়ে যায় খুনিরা। আর ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ঘরের রক্তের দাগ ও দুর্গন্ধ পরিষ্কার করে তারা।
আটক আমানের স্বীকারোক্তি ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পরদিন বিকেলে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন আমান। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, বাসা থেকে বের হয়ে পাশের একটি শপিংমলের সামনে ট্রলিব্যাগটি তিনি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম ব্যাগ নিয়ে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যান। আরেকটি ব্যাগ বাসাতেই ছিল। ওই ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছিল। সহযোগীদের ট্রলিটি অন্য কোথাও ফেলে দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে ১৫ মে শিলিস্তাকে নিয়ে আমান ঢাকায় চলে আসেন।
মরদেহ পাওয়ার আশা খুবই কম জানিয়ে ডিএমপি ডিবি প্রধান বলেন, ‘তারপরও চেষ্টা করছি এমপি আনারের দেহের কিছু খণ্ড অন্তত উদ্ধার করার। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী আমানুল্লাহ ছদ্মনাম। তার নাম শিমুল ভূঁইয়া। তিনি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। বর্তমানে আমানুল্লাহ ও পরিকল্পনাকারী শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমান ডিবির হাতে আটক রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পুরো ঘটনা জানা গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এমপি আনারকে হত্যার পর শাহিনের গার্লফেন্ড শিলাস্তি ও আমানুল্লাহ ১৫ মে এবং মোস্তাফিজ ১৬ মে ঢাকায় ফেরেন। এরপরই ভিস্তা এয়ারলাইন্সে করে মূল পরিকল্পনাকারী শাহিন দিল্লি হয়ে কাঠমাণ্ডুতে চলে যান। বর্তমানে তিনি পলাতক।’
হারুন বলেন, “১৮ তারিখ গোপাল বিশ্বাস বন্ধু আনার নিখোঁজ উল্লেখ করে কলকাতার সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশে জিডি করেন। পরে হত্যাকারীরা ভিকটিমের মোবাইল ফোন থেকে কল ও মেসেজ দিয়ে বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করে। এর অংশ হিসেবে ‘দিল্লি যাচ্ছি’ জানিয়ে ১৮ মে এমপি আনারের ফোন থেকে বার্তাও দেয়া হয়।’
কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে জানিয়ে হারুন বলেন, ‘একটি টিম আজ (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশে আসছে। প্রয়োজনে আমরাও সেখানে গিয়ে তদন্ত করব।’
এদিকে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আখতারুজ্জামান শাহীন। শাহীন ঝিনাইদহের বাসিন্দা ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তার ভাই সহিদুজ্জামান ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র।