বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর চিফ ইঞ্জিনিয়ার নওগাঁর এএসএম সাইদুজ্জামান। ভারত মহাসাগরে সোমালীয় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি এখন স্বজনের কাছে। জেলা শহরের পলিটেকনিক এভিনিউয়ে দুবলহাটি রোডের বাড়িতে পৌঁছার পর সবার চোখেই ছিল আনন্দ অশ্রু।
সাইদুজ্জামান নওগাঁর স্থানীয় একটি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে। বুধবার দুপুরের দিকে রাজশাহী বিমানবন্দরে সাইদুজ্জামান পৌঁছলে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর নিজ বাড়িতে পৌঁছলে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা তাকে শুভেচ্ছা জানান।
বুধবার বিকেলে সাইদুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র কন্যা শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। স্ত্রী মানহা তাহরিন শতধার চোখ-মুখে প্রাপ্তির হাসি। অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। শিশু সন্তানটিও যেন কোল থেকে নামছেই না। সব মিলে পরিবারে বইছে আনন্দের জোয়ার। চলছে নানা আয়োজন। তাকে দেখতে ভিড় করছেন আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মানুষ।
কেমন কেঁটেছিল দীর্ঘ ৬৩ দিন জানতে চাইলে সাইদুজ্জামান আবেগতাড়িত কন্ঠে বলেন, ‘মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছি। সৃষ্টিকর্তাসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। পরিবারের কাছে ফিরতে পারব কিনা সেই নিশ্চয়তা ছিল না।
‘জীবনের ওই ক’টা দিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখন অনেক ভালো লাগছে। ভেবেছিলাম হয়তো আর কোনদিন কারও সঙ্গে দেখা হবে না। আল্লাহর রহমতে আর বাবা মায়ের দোয়ায় সুস্থভাবে ফিরে এসেছি। আমাদের উদ্ধারে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত রুট দিয়েই জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিলাম। রেড জোনের মধ্যে আমরা ছিলাম না বা অতিক্রমও করিনি। প্রথমে জলদস্যুদের ছোট বোট দেখে মনে হয়েছিল তারা হয়তো ফিশিং বোট ব্যবহার করছে মাছ ধরার জন্য। পরে তো আমাদের ঘিরে ফেললো ওরা।
‘জলদস্যুরা সামান্য ধাক্কাধাক্কি করেছে আমাদের সঙ্গে। এর বেশি কোনো কিছু হয়নি। রোজার সময় ছিল। জাহাজে পর্যাপ্ত খাবার না থাকলেও খাওয়া নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে আমরা বেঁচে ফিরব কিনা তা নিয়েই মানসিকভাবে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’
সাইদুজ্জামান বলেন, ‘জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতি আসবে তা কখনও ভাবতে পারিনি। দুর্বিষহ দিন কেটেছে। সব সময় আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করতে হয়েছে। এরকম দিন যেন কারও জীবনে না আসে।
‘সুস্থভাবে বাড়ি ফিরতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। অনেক ভালো লাগছে। প্রধানমন্ত্রী, জাহাজ কোম্পানি, মিডিয়াসহ সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
জাহাজে ফিরবেন কিনা জানতে চাইলে এমভি আব্দুল্লাহর এই চিফ ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘এটা একটা চ্যালেঞ্জিং জব। আমি এটা কনটিনিউ করতে চাই। আমার সাথে জাহাজে যেসব সহকর্মী ছিল তারাও মনোবল হারায়নি। একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে এতদিন গেছে। তাই ৬ মাস ছুটিতে থাকব। পরিবারকে সময় দেব। এই সময়টা নিজের মতো করে কাটাব। তারপর আবার কাজে যোগদান করব।’
সাইদুজ্জামানের মা কোহিনূর বেগম বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা সন্তান আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। ছেলেকে কাছে পেয়ে কী যে শান্তি লাগছে তা বুঝাতে পারব না।
‘নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছি। ছেলের পছন্দের বিভিন্ন খাবার রান্না করছি। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা আসছে। সবাই খুব খুশি। সরকার, জাহাজ কোম্পানিসহ সবাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।’
সাইদুজ্জামানের স্ত্রী মানহা তাহরিন শতধা বলেন, ‘স্বামীকে ফিরে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। এতগুলো দিন আমাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সুস্থভাবে বাড়িতে আসায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জাহাজ কোম্পানিসহ দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
প্রসঙ্গত, মোজাম্বিক থেকে ৫৬ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে ১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুরা ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি জিম্মি করে। ১৪ এপ্রিল ভোরে জাহাজটি জলদস্যুমুক্ত হয়। এ সময় ৬৫ জন জলদস্যু জাহাজটি থেকে বোটে নেমে যায়।
এরপর ২২ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে ভেড়ে। বহন করা কয়লা খালাস শেষে ২৭ এপ্রিল স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নতুন ট্রিপের পণ্য লোড করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিনা সাকার বন্দরে যায় জাহাজটি। সেখান থেকে চুনাপাথর নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয় এমভি আব্দুল্লাহ। সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তির ঠিক এক মাস পর মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে পৌঁছায় এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি আব্দুল্লাহ’। আর জাহাজের ২৩ নাবিককে ফিরে পান স্বজনরা।