বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

২৭ মাসে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন দুই ডিজিএম

  •    
  • ১১ মে, ২০২৪ ২৩:৪৯

প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে রবিউল করিম ঢাকায় চারটি ফ্ল্যাট, রংপুরে বাগানবাড়ি ও নাটোরে ৫০ বিঘা জমি কেনেন। আর শান্তনু কুমার দাশ রাজধানীতে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দুটি প্লট ও গাড়ির মালিক হয়েছেন। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও মিলেছে মোটা অংকের টাকা।

মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড আন্তর্জাতিক মানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য সেবামূলক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও আমদানিকারক এই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ কোটি টাকা। উপরন্তু পরস্পর যোগসাজশে তারা প্রতিষ্ঠানের আরও ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন করেছেন।

আলোচিত ওই দুই ব্যক্তি হলেন- মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রবিউল করিম ও শান্তনু কুমার দাশ।

মাত্র ২৭ মাস ৮ দিনের চাকরি জীবনে এই দুই কর্মকর্তা কোম্পানিটির সুনাম ও আর্থিক ক্ষতি করে নামে-বেনামে কিনেছেন একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি, প্লট ও জমি। তাদের ব্যাংক হিসাবেও মিলেছে মোটা অঙ্কের টাকা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান থানা সম্প্রতি এই দুজনকে গ্রেপ্তার করে। একদিনের রিমান্ড শেষে তারা এখন কারাগারে।

মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডের একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে রবিউল করিম প্রতিষ্ঠানটিতে ডিজিএম পদে যোগ দেন ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর। অপরজন শান্তনু কুমার দাশ একই পদে যোগদান করেন ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল। তবে তাদের দুর্নীতি ডালপালা মেলে ২০২১ সালের শেষের দিকে।

কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডির) চৌধুরী হাসান মাহমুদ ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর মারা যান। আর তার অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান অভিভাবক হয়ে দাঁড়ান এই দুই কর্মকর্তা।

কোম্পানীর মালিক কর্তৃপক্ষ এই দুই কর্মকর্তার ওপর সরকারি বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে সেবাদান কার্যক্রম দেখাশোনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমডির অনুপস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করে রবিউল করিম ও শান্তনু কুমার দাশসহ তাদের সহযোগীরা নিজেদের আখের গোছাতে নেমে পড়েন। পরস্পর যোগসাজশে তারা গড়েন অনিয়ম-দুর্নীতির সিন্ডিকেট।

চাকরিদাতা কোম্পানিকে না জানিয়ে তারা নিজেরাই একাধিক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডে চাকরিরত অবস্থাতেই পদ-পদবী ব্যবহার করে তারা নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন।

দুর্নীতিবাজরা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভুয়া প্যাড, ভুয়া নথি ও দলিল বানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অগোচরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রবিউল ও শান্তনু মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডে ডিজিএম পদে কর্মরত থাকলেও তাদের বেতনের অংকটা আহামরি কিছু ছিল না। স্বল্প বেতনের এই দুই চাকুরে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেন ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারা যাওয়ার পর।

এমডির মৃত্যুর পর থেকে ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ মাস ৮ দিন চাকরিকালে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এই দুই দুর্নীতিবাজ। তাদের জালিয়াতি-দুর্নীতির বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে চলতি বছরের ১ এপ্রিল। ওইদিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের একটি কারণ দর্শানো নোটিশ কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পর তাদের ভয়াবহ মাত্রার দুর্নীতি প্রকাশ হয়ে ড়ে।

মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ওইদিনই প্রথম জানতে পারে যে, ডিজিএম রবিউল ও শান্তনু প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ও সরকারি সংস্থার কাছে তথ্য গোপন করে দ্য ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল নামে এক প্রতিষ্ঠানের প্যাডে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন। একইসঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের সিইও ও ব্যবস্থাপনার অংশীদার হিসেবে স্বাক্ষর করেন রবিউল।

প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত রবিউল। ডিজিডিপির নোটিশ আসার পর প্রতিষ্ঠানটি আরও জানতে পারে, রবিউলের এই অপকর্মের সঙ্গে কোম্পানির আরেক ডিজিএম শান্তনু কুমার দাশও জড়িত।

পরবর্তীতে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসা ফেঁদেছেন ওই দুই কর্মকর্তা। তারা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ‘দ্য ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল’ নামে এক প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে অংশ নিতেন। আর এ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ বহন করতো মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং।

মেডিগ্রাফিক ট্রেডিংয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমেই অনিয়মের বিষয়টি ধরে ফেলে। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো চিঠি ইস্যু হলে এই দুই কর্মকর্তা আগেভাগে যোগাযোগ করে কৌশলে তা রিসিভ করে নিতেন।

অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের জবাব চেয়ে মন্ত্রণালয় থেকে পরপর তিনবার চিঠি পাঠানো হয়। আর প্রতিবারই এমডির স্বাক্ষর জাল করে সেই চিঠির উত্তর দেন রবিউল ও শান্তনু।

দ্বিতীয় চিঠিটি প্রতিষ্ঠানের ১৪ পুরানো পল্টন, রেজিস্টার অফিসে এলে রবিউল করিম কৌশলে অফিস কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে অফিসে পৌঁছে দেয়ার নাম করে জোর করে নিয়ে আসেন।

তবে ঈদুল ফিতরের ছুটির সময় এই দুই ডিজিএম বাড়ি চলে গেলে তৃতীয় চিঠিটি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। আর তখনই তাদের প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে যায়।

কর্মকর্তারা বলেন, মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সুনামও ক্ষুণ্ন করেছেন রবিউল ও শান্তনু। পরস্পর যোগসাজশে তারা কোম্পানির লেটার হেড প্যাড ব্যবহার করে তাতে জাল স্বাক্ষর দিয়ে ১৩ এপ্রিল প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরে চিঠিও ইস্যু করেন। ওই চিঠিতে রবিউল উল্লেখ করেন, তিনি কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে আছেন।

শুধু তাই নয়, তথ্য গোপন করে রবিউল তার ব্যক্তিগত ও কোম্পানির ব্যাংক হিসাব নম্বর ব্যবহার করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। এই দুজন গ্রাহকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিতেন। নামে-বেনামে কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে টাকা পকেটে ভরে তা বকেয়া দেখাতেন।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান করে জানতে পারে, এই দুই কর্মকর্তা সামান্য বেতনের চাকুরে হয়েও অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে গেছেন।

কোম্পানির হিসাবমতে, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী হাসান মাহমুদ মারা যাওয়ার পর এই দুজন তাদের চাকরিকালীন ২৭ মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া মেডিগ্রাফিক প্রতিষ্ঠানের আরও ৩০ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা অনেকদিন ধরেই আমাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি তদন্ত করে জানতে পেরেছি, তারা নিজেদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ও তথ্য গোপন করে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে গড়ে তোলেন। আর এভাবে তারা আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া পরোক্ষভাবে আরও ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন করেছেন।’

জাল-জালিয়াতি ধরা পরার পরপরই মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং থেকে ওই দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শেখ জাকির হোসেন ২৪ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন। ওইইদিনই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, প্রতারণার মাধ্যমে কোম্পানির টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলায় রবিউল ও শান্তনুকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টির তদন্ত চলছে।

গুলশান থানা পুলিশ জানায়, রবিউল করিম চাকরিকালীন তথ্য গোপন করে ‘দ্য ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল’, ‘বাংলাদেশ সাইন্স হাউজ’ ও ‘প্রযুক্তি ইন্টারন্যশনাল’ এবং শান্তনু কুমার দাশ ‘নোরামেড লাইফ সাইন্স’ নামে কোম্পানি খোলেন।

মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডের নামে আসা সব কাজ তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতেন। এভাবে অল্প দিনেই প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকায় রবিউল করিম রাজধানীতে বিলাসবহুল চারটি ফ্ল্যাট, রংপুরে বাগানবাড়ি ও নাটোরে ৫০ বিঘা জমি কেনেন। আর শান্তনু কুমার দাশ রাজধানীতে কেনেন দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দুটি প্লট ও গাড়ি। এছাড়া তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোটা অংকের টাকা পাওয়া গেছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই অল্প সময়ে এতো অর্থ-সম্পত্তির মালিক কিভাবে হলেন- তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেননি রবিউল ও শান্তনু।

মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড জানায়, সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হাসান মাহমুদ চৌধুরী জীবিত থাকাকালেও চেক জালিয়াতির কারণে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়। এছাড়া গ্রেপ্তার হওয়ার এক সপ্তাহ আগেও কোম্পইনর একটি চেক জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা পড়েন তারা।

এ বিভাগের আরো খবর