ঝালকাঠির রাজাপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক নারী ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জরায়ুতে অস্ত্রপচার হওয়ার কথা থাকলেও ভুলবশত কাটা হয়েছে তার পেটের নিচের অংশ; ভুল শুধরে সেখানে আবার দেয়া হয়েছে সেলাই।
ভুক্তভোগী বলছেন, যে নারী চিকিৎসক তার অপারেশন করবেন বলে তিনি সেখানে গিয়েছেন ওই নারী চিকিৎসক তার অপারেশন করেননি। অপারেশনে অংশ নিয়েছে দুজন ছেলেসহ তিনজন।
সোহাগ জেনারেল হাসপাতাল (সোহাগ ক্লিনিক) নামের হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভুক্তভুগী রোগী ও তাদের স্বজনরা। তবে হাসপাতাল মালিক দুষছেন গণমাধ্যম কর্মীদের।
জরায়ু অপারেশন করার জন্য ৮ মে গাইনি চিকিৎসক রুনা লায়লার অধীনে সোহাগ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৮ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী কহিনুর বেগম।
তিনি জানান, ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে জরায়ু অপারেশন না করে শরীরের নিচের অংশ অচেতন করে তার পেট কাটা হয়। কিছুক্ষণ পরই আবার পেট সেলাই করে আটকে দেয়া হয়।
শরীরে ওপরের দিকে চেতনা থাকায় রোগী নিজেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
সোহাগ জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন গাফিলতির শিকার কোহিনুরে বাড়ি পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলায়। সেখানকার শিয়ালকাঠি ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের জোলাগাতি এলাকার মুদি দোকানী হেমায়েত উদ্দিন খানের স্ত্রী তিনি।
ভুক্তভুগী রোগী কহিনুর বেগম বলেন, ‘ডাক্তার রুনা লায়না আমার অপারেশন করার কথা বলে তিনি ওটিতে আসেননি, অন্য দুইটা ছেলে আর একজন মুরব্বি আমার পেট কেটে বলাবলি করতেছিলো, আমার অন্য সমস্যা হয়েছে। তারপর তারা আবার আমার পেট সেলাই করে আটকিয়ে দিয়েছে।
‘অপারেশন থিয়েটারে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ আমার কান ও চোখ সজাগ ছিল। তাদের সব কথা আমি শুনতে পেয়েছি। পেট কাটার পর তারা ডাক্তার রুনা লায়লাকে ফোন করেছিল, তারপর ডা. রুনা লায়লা রাগান্নিত কন্ঠে বলতে ছিল ‘‘আমি তো অন্য ওটিতে সিজার করতে আসছি, এই রোগীকে কেনো এতো তাড়াতাড়ি ওটিতে নিয়েছো।’’ এর পরে ওরা আমার পেট সেলাই দিয়ে আটকিয়ে আমাকে ওটি থেকে বের করে দিয়েছে। তাহলে আমার পেট কে বা কারা কাটলো তা আমি জানি না।’
ঘটনা জানাজানি হলে বিষয়টি নিয়ে সরজমিন অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রোগী, রোগীর স্বজন এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
জানা যায়, কোহিনুর বেগম জরায়ু সমস্যা নিয়ে সোহাগ জেনারেল হাসপাতালে বরিশাল থেকে আসা ডা. রুনা লায়লার স্মরণাপন্ন হন। ডাক্তার রুনা লায়লা রোগীর যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে জরায়ু অপারেশনের জন্য তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে দেন।
নির্ধারিত দিন ৮ মে তারা ভর্তি হলে সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় অপারেশনের। কিন্তু ডা. রুনা লায়লা ওটিতে এসে নিজে অপারেশন না করে সহকারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। সহকারীরা পেট কেটে একটি চাকা সাদৃশ্য কিছু দেখতে পেয়ে পেট সেলাই দিয়ে আটকে দেন।
পরে ডাক্তার রুনা লায়লা এসে রোগীর স্বনদের বলেন, ‘কোহিনুরের অন্য সমস্যা আছে, তাকে ঢাকা ক্যানসার হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছি, সেখানে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে হবে।’
ডাক্তারের এই সিদ্ধান্তের পরে রোগী কহিনুরের স্বামী, সন্তান এবং অন্য স্বজনরা হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, যদি অন্য সমস্যাই থাকে তাহলে তারা এটা না বুঝে কেন পেট কাটল? প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই বা কেন অপারেশন করা হইলো? আমরা এই বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। একই সাথে আমরা আমাদের সব ধরনের ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।
কোহিনুরের স্বামী ও সন্তানরা অনেকটা উত্তেজিত হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ম্যানেজ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সংবাদিকদেরকে তথ্য না দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
ভুক্তভোগী রোগীর সাথে কথা বলতে গেলে নিউজবাংলার প্রতিবেদককে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যেতে বলেন সেখানকার একজন কর্মচারী।
তবে হাসপাতালের চেয়ারম্যান আহসান হাবীব সোহাগ ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের কোনো আপনজন নেই, আমি বাইরে থাকাকালীন সময়ে হাসপাতালে সাংবাদিকদের ঢুকতে না দিতে আমি আমার ষ্টাফদেরকে বলে রেখেছি।’
কোহিনুরের ভুল চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দায়িত্বরত চিকিৎসক আমাকে বলেছে, পেট কাটার পরে একটা চাকার মত দেখতে পায় তারা, যেটা এখানে কাটলে রোগী মারা যেতে পারে আবার ওখানে ক্যানসারের জীবাণুও থাকতে পারে। তাই ঢাকায় গিয়ে বায়োপসি পরীক্ষা করার জন্য পরামর্শ দেয় হয়েছে। এখানে হাসপাতাল মালিক কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তারের কোনো ভুল নেই।’
তবে অপারেশন থিয়েটারে কোহিনুরের নির্ধারিত চিকৎসক গাইনি বিশেষজ্ঞ রুনা লায়লা ছিলেন কি না, সে প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে যান আহসান হাবিব সোহাগ।
ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম জহিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি, অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে যদি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন আমাদের নজরে আসে তাহলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’