বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হাওরে নতুন আতঙ্ক বজ্রপাত, পূর্বাভাস পায় না কৃষক

  •    
  • ৭ মে, ২০২৪ ২২:২৪

ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাওর এলাকায় বছর পাঁচেক লক্ষাধিক তাল বীজ রোপণ করা হয়। তবে সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। বেশিরভাগ তাল বীজ থেকে চারাই গজায়নি।

সিলেট বিভাগের হাওর এলাকার নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে বজ্রপাত। বৃষ্টির মৌসুমে হাওরে ঘনঘন ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। এতে বাড়ছে প্রাণহানি। কয়েকবছর ধরে এমনটি ঘটতে থাকলেও এই ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় তেমন কোনো প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়নি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে।

এরইমধ্যে গত দুদিনে (রবি ও সোমবার) সিলেট বিভাগে বজ্রঘাতে ৬ জনের প্রাণ গেছে। এদিকে বর্ষায় বজ্রপাতের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

কয়েকবছর ধরেই হাওরে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে চললেও বজ্রপাতের আগাম তথ্য হাওরবাসীর কাছে পৌঁছানের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এ পর্যন্ত। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হাওর এলাকায় কিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি উঠলেও এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা নেই প্রশাসনের।

ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাওর এলাকায় বছর পাঁচেক লক্ষাধিক তাল বীজ রোপণ করা হয়। তবে সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। বেশিরভাগ তাল বীজ থেকে চারাই গজায়নি।

এ অবস্থায় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হতেই সিলেটে বেড়ে গেছে বজ্রপাত আর প্রাণহানি।

সোমববার সিলেটের কানাইঘাট, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বাহুবলে বজ্রপাতে মারা গেছেন ৩ জন। তার আগেরদিন রোববার সিলেটের গোয়াইনঘাট, মৌলভীবাজার সদর ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বজ্রপাতে আরও তিনজন নিহত হন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম পিয়ার-রিভিউ জার্নাল হেলিয়ন-এ ‘বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম)-ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ প্রাণহানি বর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে, যার মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সিলেট) সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দেশের আবহাওয়ার ধরণ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ এবং ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে। এ কারণেই বাড়ছে বজ্রপাতের পরিমাণও।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, বৈশাখ থেকে ঝড়বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ে। আর এই সময়টাই হাওরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়। হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান তোলা হয় এই সময়ে। ফলে কৃষকদের মাঠে গিয়ে উপায় নেই। এ কারণে প্রাণহানিও বাড়ে।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সিলেট বিভাগের ১০৫টি হাওর আছে সিলেট জেলায়। আর সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর রয়েছে ১৩৫টি।

হাওর বেশি হওয়ায় দেশের সবচয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাও সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮ বছরে বজ্রপাতে সুনামগঞ্জে অন্তত ১৫০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ লেগে থাকলেও সুনামগঞ্জে কোনো আবহাওয়া অফিস নেই।

এদিকে, বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে সিলেট আবহাওয়া অফিসেও স্থাপন করা হয় বজ্রপাত পূর্ভাবাস যন্ত্র ‘থান্ডারস্ট্রোম ডিটেকটিভ সেন্সর’। এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিদিনই বজ্রপাতের পূর্ভাবাস আসে। আবহাওয়া অফিস থেকে এই পূর্ভাবাস প্রতিটি জেলার সরকারি অফিসগুলোতে ই-মেইলে পাঠানো হলেও তৃণমূলে প্রান্তিক মানুষের কানে তা গিয়ে পৌঁছে না। হাওরের কৃষকদের কাছে বজ্রপাতের পূর্ভাবাস পাঠানোর জন্য সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি এ পর্যন্ত।

সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব বলেন, ‘২০১৬ সালের পর থেকে বজ্রপাতকে একটি দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। সাধারণত পাহাড়বেষ্টিত এলাকা ও খোলা জায়গায় বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। এই হিসেবে সিলেট বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।’

তিনি বলেন, ‘১২ ঘণ্টা আগে আমরা বজ্রপাতের পূর্ভাবাস পাই। আমরা যে বজ্রপাত পূর্ভাবাস সরকারি দপ্তরগুলোতে পাঠাই সেটি হাওরাঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদেরই দায়িত্ব নিয়ে এটি করতে হবে।

‘পূর্ভাবাস পেলে ওই সময় হাওরে কাজ করা থেকে তারা বিরত থাকতে পারবেন। তবে ডিজিটাল মাধ্যমে যে কেউ আবহাওয়ার পূর্ভাবাস জানতে পারবেন। মোবাইলে ওয়েদার অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ সেই তথ্য পেতে পারেন।’

বজ্রপাত আটকে দেবে তালগাছ- এই ধারণা থেকে কেবল সুনামগঞ্জ জেলায়ই ২০১৮ সালে ৩৪ হাজার ও চলতি বছরে ৮০ হাজার তাল বীজ বিতরণ করা হয়। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এই লক্ষাধিক বীজ থেকে হাজারখানেক চারাও গজায়নি।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ৫ নম্বর সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী বলেন, ‘২০১৭ সালে উপজেলা প্রশাসন থেকে আমাদের কিছু তাল বীজ দেয়া হয়। আমরা সেগুলো রোপন করেছি, কিন্তু গাছ হয়নি; সব বীজই নষ্ট হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘বজ্রপাতের কোনো পূর্ভাবাস আমরা পাই না। তাই যখন দেখি আকাশের অবস্থা ভালো না, তখন ইউপি সদস্যদের ফোন দিয়ে বলি তাদের এলাকায় কেউ যেন মাঠে না যায়।’

সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় ২০১৮ সালে তাল বীজ বিতরণ করা হয়। সেসময় তাল বীজ দিয়েই দায় সেরেছে জেলা প্রসাশন, পরবর্তীতে আর কোনো তদারকির ধার ধারেনি। করা হয়নি।

তবে হাওর নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতা নেই প্রশাসনের। দায়সারা ও অকার্যকর তাল বীজ বিতরণের সীমাবদ্ধ প্রশাসনের সব পদক্ষেপ।

এ ব্যাপারে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ‘বৃষ্টির মৌসুমেই বোরো ফসল ঘরে ওঠে। তাই এই সময়ে কৃষকদের মাঠে যেতেই হবে। এজন্য হাওরে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি আমরা, যাতে কৃষকরা মাঠে কাজ করতে গেলে বজ্রবৃষ্টির সময় সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। এছাড়া হাওরে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন করাও প্রয়োজনীয়। এসব দাবি আমরা বিভিন্ন সময় জানিয়েছি, তবে মৌখিক আশ্বাস ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।’

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হাওর এলাকায় তাল বীজ রোপন ও বিতরণ করা হয়েছিল। তবে এটা অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এখন গাছগুলোর কী অবস্থা তা জানা নেই। ইউএনওদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে জানাব।’

এ বিভাগের আরো খবর